২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ১১:৫০
শিরোনাম:

শিশু পুত্রকে মেরে মাকে হুমকি দিচ্ছে ‘বাবা’

শিশু পুত্রকে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগে খোদ বাবার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় মামলা করে বিপাকে পড়েছে এক মা। মামলা করে উল্টো নিজের এবং শিশুর জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বাদী শাওন রোমালিয়া নামের ওই মা।

তিনি তার সাবেক স্বামী খিলক্ষেতের বাসিন্দা মাদকাসক্ত আবদুল্লাহ আল তারেকের বিরুদ্ধে ১৯ সেপ্টেম্বর শিশু নির্যাতনের মামলা করেন।

প্রথমে খিলক্ষেত থানা পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করলেও ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলম, পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা, ওয়ারি বিভাগের এডিসি ইফতেখারুল ইসলাম ইফতিসহ গুলশান ডিভিশনের সিনিয়র অফিসারদের হস্তক্ষেপে থানা পুলিশ মামলা রেকর্ড করে। মামলা নেয়ার পরপরই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। বর্তমানে আসামি জেল হাজতে রয়েছে। অভিযোগ আছে আসামি সেখান থেকেই মামলা প্রত্যাহারের জন্য বাদীকে হুমকি দিচ্ছে।

বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) খিলক্ষেত থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ছেলেটির মা শাওন।

জিডিতে শাওন রোমালিয়া বলেন, ‘বিবাদীর আত্মীয় স্বজন এবং অন্য লোকজন মামলা প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করছে। এমনকি আসামি জামিন পেলে আমিসহ আমার ছেলে আরহানের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে।’

ঘটনার শুরু ১৭ সেপ্টেম্বর। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার ক-২০৫/১ বাড়ির চারতলার ফ্লাটে বাবা আবদুল্লাহ আল তারিক নিজের শিশু সন্তান আরহানকে সাবেক স্ত্রী শাওন রোমাইলার কাছে থেকে নিয়ে আসেন। ১৭ সেপ্টেম্বর সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে সন্তানকে বেদম পিটিয়ে সারা শরীর রক্তাক্ত করেন তিনি।

শিশুটিকে বাঁশের লাঠি এবং পাইপ দিয়ে অমানবিকভাবে পেটানো হয়। মারধর সহ্য করতে না পেরে শিশুটি বাসা থেকে পালিয়ে পাশেই তার ফুফু সুমাইয়ার বাসায় খালি পায়ে এবং খালি গায়ে চলে যায়।

সেখান থেকে তার ফুফু উবারের গাড়ি ডেকে শিশুটিকে একাই মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা শাওন রোমালিয়া। ছেলেকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাতে গিয়ে সাবেক স্বামীর হুমকিতে পালিয়ে এসে ধানমন্ডির এক বান্ধবীর বাসায় আশ্রয় নেন।

ছেলেকে তার বাবা অপহরণ করতে পারে এই ভয়ে আরহানকে আরেকজনের বাসায় রেখে আসেন। থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতেও ভয় পাচ্ছিলেন শাওন। কারণ খিলক্ষেত এলাকার তার স্বামী তারিকের পরিবার খুবই প্রভাবশালী। এ পরিস্থিতে এগিয়ে আসে আতিয়া বিলকিস মিতু নামে রোমামিলার এক বান্ধবী।

সে তার পূর্ব পরিচিত এক সাংবাদিককে বিষয়টি জানান। পরে ফেসবুকে সাহায্য চেয়ে ওই সাংবাদিক পোস্ট দিলে বিষয়টি পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসারদের নজরে আসে। এতে নড়ে চড়ে বসেন পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলম, পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা, ডিএমপির ওয়ারী ডিভিশনের এডিসি ইফতেখারুল ইসলাম ইফতি, গুলশান ডিভিশনের এডিসি মোস্তফা মামুন অন্যতম।

তারা ভিক্টিম শিশু এবং তার অসহায় মায়ের পাশে আইনগত সাহায্য নিয়ে দাঁড়ান। তারা নিজ উদ্যোগে শিশুটির মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভয় দেন। ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলম নিজেই খিলক্ষেত থানার ওসি মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে সার্বিকভাবে বিষয়টি জানান। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে ওসি তাকে জানায় যে, অভিযুক্ত তারিক আমেরিকার অভিবাসী এবং সেখানকার বড় ব্যবসায়ী। তাই মামলা রেকর্ড ছাড়া তাকে গ্রেফতার করা ঠিক হবে কিনা এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে খিলক্ষেত থানা পুলিশ। কিন্তু যুগ্ম-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম খিলখেতের ওসিকে নিজের দায়িত্ব অবহিত করেন।

ওসি মোস্তাফিজুর বলেন, বুধবার রাতে যুগ্ম-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম স্যারের ফোনে সংবাদটি শুনে ফেসবুকে শিশুটির উপর নির্যাতনের ছবিগুলো দেখে স্যারের সহায়তায় শিশুটির পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলি।

‘শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেলের ওসিসিতে ভর্তি করাতে তার মাকে বলি। তাকে এজাহার দেয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি এত রাতে একাকী আসতে পারবেন না বলে জানান। একটি বিষয় মাথায় ঘুরতে থাকলো কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে যদি অপরাধী পালিয়ে যায় তখন কি হবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ডিসি ও এসি স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘একই সঙ্গে দুটো কাজ হাতে নিই। প্রথমতঃ অপরাধী আলী তারিককে গ্রেফতারের জন্য শিশুটির মায়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে গ্রেফতার অভিযান ও শিশুর মায়ের কাছ থেকে এজাহার সংগ্রহ করা।’

‘আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শিশুটির মাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তার কাছ থেকে এজাহার সংগ্রহ এবং একই সঙ্গে অপর দুটি টিম গভীর রাতে তারেকের বাড়ী শনাক্ত করে বাড়ির চতুর্থ তলা থেকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়।’

এ নির্যাতন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. মিজানুর রহমান বলেন, আসামিকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আদালত আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসবাদের অনুমতি দিয়েছেন। আসামি তারিক এখন কারাগারে।

পুলিশের এমন জনমুখিসেবা পেয়ে বাদী শাওন রোমালিয়া বলেন, এ পুলিশ আসলে সেই পুলিশ নয়। আগে শুনতাম মামলা করতে গেলে থানা পুলিশের কাছে অনেক ধর্ণা দিতে হয়। কিন্তু আমি দেখলাম সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের হস্তক্ষেপে থানা পুলিশের টিম নিজেরা সেই খিলক্ষেত থেকে গভীর রাতে ধানমন্ডিতে এসে আমার কাছে থেকে লিখিত অভিযোগ নিয়ে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আসামিকে গ্রেফতারও করেছেন। আপ্লুত শাওন বলেন, আমি পুলিশের এই সেবার জন্য খুবই খুশি। আশা করি ন্যায় বিচার পাবো।