২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ১১:২৮
শিরোনাম:

বাকশালের মাধ্যমে শোষণহীন এক সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

সুভাষ দাশগুপ্ত : স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের সমস্ত পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিলো অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংস¤পূর্ণ করা এবং সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের জীবনমানের উন্নয়ন সাধন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত কতিপয় বিশেষ গোষ্ঠী নবগঠিত সরকারকে সাহায্য করার পরিবর্তে দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রকাশ্যে ও গোপনে স্বাধীনতার স্বাদ সবার মাঝে পৌঁছে দিতে বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। ক্রমাগতভাবে এসব অপশক্তি তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার প্রয়াস চালায় এবং বিভিন্ন দিক থেকে এই সরকারের পতনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এদের মধ্যে নিম্নে উল্লিখিত কার্যকলাপগুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে:

[১] স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা তখনো স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে আবারও পাকিস্তানের অংশ হয়ে থাকা অথবা স্বাধীন পূর্ব-পাকস্তিান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে।

[২] পাকিস্তানি আমলাতন্ত্রে বিশ^াসী সরকারি চাকরিজীবিরা গোপনে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিকে আবারও জেগে ওঠার সাহস জোগাতে থাকে।

[৩] অর্জিত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে পূর্ব পাকিস্তানের অতি বিপ্লবী সংগঠনগুলো তথাকথিত পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র¿ বিপ্লবের ডাক দেয়।

[৪] স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির একাংশ বঙ্গবন্ধু সরকারকে অসহযোগিতা করতে থাকে।

[৫] পাকিস্তান ফেরত খন্দকার মোশতাকের মদদপুষ্ট আমলাতন্ত্র সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করতে থাকে।

এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু সরকার যেভাবে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এ দেশের আপামর জনসাধারণকে একত্রিত করে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং পরবর্তী সময়ে এক সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, সেভাবে আবারও আপামর জনসাধারণকে একত্রিত করে অপশক্তিকে পরাজিত করে তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রস্তুতি নেন।

বলাবাহুল্য পরাজিত শক্তি ছাড়াও তার নিজের দলেরও কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে। দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এবং আর্ন্তজাতিক অবস্থার নিরীখে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রতিষ্ঠার সদ্ধিান্ত ছিলো এক যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এর আদর্শগত দিক ছিলো যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে নতুন শপথে দীক্ষিত করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণ। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন এর জন্য নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম প্রয়োজন এবং সমগ্র জাতিকে যুদ্ধংদেহী মনোভাব ত্যাগ করে শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য অন্য রকম উদ্বুদ্ধকরণ প্রয়োজন। সবাইকে নিয়ে সবার জন্য উন্নয়ন- এটাই ছিলো বাকশাল প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে জাতির ভেতর শৃঙ্খলাবোধ (জবমরসবহঃধঃরড়হ) না থাকে সেই জাতিকে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করা যায় না।

বাকশাল গঠনের বহুবিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে নিম্ন বর্ণিতগুলো ছিলো মুখ্য।

[১] একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

[২] জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করে একটি জনকল্যাণমুখী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে সরকারি সেবা দ্রুততম সময়ে গরিব লোকদের কাছে পৌঁছানো।

[৩] বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বহির্বিশ্বকে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছিলেন যে, এটা কোনোক্রমেই কমিউনিস্ট পার্টি নয়। তবে একথা সত্য যে, তিনি বাকশালের মাধ্যমে এক শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

[৪] দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিলো, একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দেওয়া এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিলো শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সংবিধানের ১৪নং ধারায় বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতী মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দান করা’ এবং ১৬নং ধারায় বলা হয়েছে ‘গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বপ্লিব’। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের মধ্যে শৃঙ্খলা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাঁর অন্যতম লক্ষ্য ছিলো যেন সমগ্র জাতি একই চিন্তায় উদ্বুদ্ব হয়ে একই সঙ্গে তার বাস্তবায়ন করে। তিনি বিশ^াস করতেন এই পদ্ধতিতেই অতি স্বল্পতম সময়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এর অনুকূলে ছিলো না। বঙ্গবন্ধু যে লক্ষ্য ৫০ বছর পূর্বে বাঙালির জাতির জন্য স্থির করেছিলেন তা ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (ঝউএং)’ প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু দরিদ্রতম জনসাধারণের রাজনৈতিক সতেনতা বৃদ্ধি করে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ওহপষঁংরাব) অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই চিন্তাধারা অর্ধশতক পর (ঝউএং) তে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন প্রায় ৫ দশক আগে এবং তার প্রতিফলন হয়েছিলো বাকশাল গঠনে।

তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করতেন যে দেশের উন্নয়নে দরিদ্র জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো ১৯৭৮ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন। আমরা জানি এটা (ঝউএং) প্রথম ও দ্বিতীয় লক্ষ্যমাত্রার অন্তর্ভুক্ত। এই লক্ষ্য অর্জনে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন আমলাতন্ত্রের ভেতর এক যুগোপযোগী পরিবর্তন আনতে যেহেতু বঙ্গবন্ধু জানতেন চলমান আমলাতন্ত্র দিয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশত তিনি এই দুরূহ কাজ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। বাকশাল প্রতিষ্ঠা ছিলো বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক দর্শন-যাকে হত্যা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা তৎকালীন আমলাতন্ত্রের একাংশের যোগসাজশে। এর মূল্য জাতিকে আজও দিতে হচ্ছে। সংক্ষিপ্ত।