২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৮:২৯
শিরোনাম:

বাঙালীর অস্তিত্ব সংকট ও বঙ্গবন্ধু

সুভাষ দাশগুপ্ত : ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে। ১৪ই আগস্ট জওহরলাল নেহরু যখন ঘোষনা করেন “সারা পৃথিবীর মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন তখন ভারত তার স্বাধীনতা উদযাপন করছে”। কিন্ত বাংলায় তখনও সাম্প্রদিক দাঙ্গার রক্ত ঝরছে। গঙ্গা-ভাগীরথির জল বাঙালীর রঙ্গে রন্জিত। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনও এই রক্ত ঝরা বন্ধ হয়নি। বাংলা বিভক্তিতে নেহরু খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না, যতনা ছিলেন পান্জাবের বিভক্তি নিয়ে। কিন্তু এ বাংলা-বিভক্তি বাঙালীকে এক নতুন চ্যালেন্জের সম্মুখীন করে।

যে কোন জাতির অস্তিত্বের প্রথম নিয়ামক শক্তি হচ্ছে নির্দিষ্ট ভুখন্ড। এই ভৌগলিক সীমারেখা “দেশ প্রেমের” প্রতীক। বাঙালীর হাজার বছরের ভুখন্ডের বিভক্তি তাদের দেশপ্রেমের চেতনায় আঘাত হানে। দ্বিতীয় আঘাত আসে বাঙালীর “জাতিসত্ত্বার” উপর, যার মাধ্যমে জাতিপ্রেমের ভ্রুণ সঞ্চারিত হয়। এই জাতিপ্রেম মানবগোষ্ঠীভিত্তিক, যার সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক ঐক্যের দ্বারা। সুতরাং ১৯৪৭ এর ভারত ভাগ বাঙালীকে শুধমাত্র দ্বিধাভক্ত করেনি, তার দেশপ্রেম, জাতিসত্ত্বা ও ভাষাকে চিরতরে বিলীন করার এক নতুন ষড়যন্ত্রের সূচনা করে। তাছাড়া কোন অংশ (পূর্ববঙ্গ না পশ্চিমবঙ্গ) আদি বাঙালীত্বের প্রতিনিধিত্ব করবে ও বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে ধারন করবে তা এক কঠিন সমস্যা হিসাবে দেখা দেয়। সুতরাং ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ বাংলা, বাংলা ভাষা ও বাঙালীর অস্তিত্বকে এক কঠিন সঙ্কটে ফেলে দেয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সঙ্কটের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে বলা প্রয়োজন ততকালীন পূর্ব-বাংলার রাজনীতিবিদগণ যেমন: এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমুদ্দিন এব্যাপারে কোন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেননি।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব-পাকিস্তান বৃটিশ উপনিবেশবাদ থেকে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের কবলে পতিত হয়। শুরু থেকেই বাঙালীর স্বাধীন সত্ত্বার উপর আঘাত আসে যার শুরু ভাষা ও ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিতর দিয়ে্। এই সময়ে বাঙালী জাতিকে মহাসঙ্কট থেকে মুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসন শেখ মুজিবুর রহমান। তখনকার বাস্তবতায় যে স্বপ্ন তাঁর বুকে জেগে ওঠে তা হলো বাঙালী জাতির জন্য একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা। এস্বপ্নই বঙ্গবন্ধুকে তৎকালীন সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চিন্তাধারার গন্ডি পেরিয়ে নতুন রাষ্ট্রচিন্তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এর উপর ভিত্তি করে তিনি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার মূলমন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করেন “বাঙালী জাতির স্বাধীনতা”।

দেশ ভাগের সময় পূর্ব-পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২০ লক্ষ পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ২ কোটি ৪০ লক্ষ। আয়তনের দিক থেকেও পূর্ব-পাকিস্তান সম্পূর্ণ বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ ছিল। ইতিহাস বলে মূলত: প্রাচীন বঙ্গ, বাঙাল ও আরও কয়েকটি জনপদ নিয়ে বর্তমান পূর্ব-পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। তারপরও কোন অংশ বাংলা ভাষা ও বাঙালী জাতির প্রতিনিধিত্ব করবে তা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। যেমন: ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক সরকার তাদের প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ নামকরণ করার প্রস্তাব ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের নিকট প্রেরণ করে কিন্তু তা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন পায়নি। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের অন্যতম চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধধিক আব্দুল হক বলেছিলেন “পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলাদেশ রাখার প্রস্তাব অনৈতিহাসিক। এ যেন মূল কান্ডকে বাদ দিয়ে ডালাকে গাছ বলা ”। ড: রমেশ চন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত “হিস্ট্রি অব বেঙ্গল” এবং ড: নীহারন্জন রায় প্রণীত এবং বর্তমানে ক্লাসিক গ্রন্থে পরিণত বাঙালীর ইতিহাস বইয়ে, কেন পূর্ব-পাকিস্তানই আজকের বাংলাদেশ তা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুই প্রথম পূর্ব-পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে বাংলাদেশ বলেছিলেন এবং এর দুই বছরের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি তা প্রতিষ্ঠিত করেন।

সাম্প্রতিক কালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের প্রদেশের নাম “বাংলা” করার প্রস্তাব করেন কিন্তু তাও কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ আজ আনন্দিত হয় যখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য “জয় বাংলা” স্লোগান ব্যবহার করে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। তবে মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর “জয় বাংলা” স্লোগান ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক এবং তা নিছক স্লোগান নয়। এখানে উল্লেখ্য ১৯৪২ সালে গান্ধীজির “ভারত ছাড়” স্লোগানের চেয়ে “জয় বাংলা” স্লোগান ছিল অনেক কার্যকরী। আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার নিমিত্তে, একটি যথোচিত স্লোগান কি হতে পারে তার প্রস্তাব করার জন্য বিভিন্নজনকে অনুরোধ করেছিলেন এবং অনেকগুলো প্রস্তাবের মধ্যে গান্ধীজি “ভারত ছাড়” স্লোগানটি নির্বাচন করেন। অন্যদিকে “জয় বাংলা” বঙ্গবন্ধু নিজেই ঠিক করেছিলেন। তখন যদি বঙ্গবন্ধু গান্ধীজির অনুকরণে “পূর্ব-পাকিস্তান ছাড়” ঠিক করতেন তবে তিনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে হয়তোবা এক করতে পারতেননা।

বাংলা ও বাঙালী জাতিকে যে বৃটিশ ও পাকিস্তানীরা চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এ অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে মুক্ত করে বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালীকে যিনি এক স্বাধীন জাতির সম্মানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি হচ্ছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজার বাধা অতিক্রম করে তাঁর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণে এ বাংলায় এক শোষনহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে অবিরাম পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে যে বাঙালী জাতি আজ বাংলার ঐতিহ্য ধারন ও বহন করে চলেছে তার উত্তোরত্তর সমৃদ্ধির মাধ্যমে জাতির পিতাকে অমর করে রাখতে হবে, শতপ্রতিকূলতার মধ্যেও।