২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:৩৭
শিরোনাম:

সঞ্জয় লাহিড়ী: স্মৃতির পাতায়

সঞ্জয় লাহিড়ী, ফেসবুক থেকে: ৫১ বুলেভার্ড দ্য ত্রিওম্ফ। গত শতাব্দীর শেষ দিকের ব্রাসেলস।আমার এক বছরের ঠিকানা। প্লেন থেকে নেমে ইউনিভার্সিটিতে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দেবার পর দেখলাম অর্ধেক ট্রাভেলেরস চেক হারিয়েছি। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে পা আর চলছে না। অর্ধেক সম্পত্তি উধাও, বুঝলাম সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ আসছে।

দুকোনায় দুটো ছোট ছোট বিছানা। মাথার উপরে তাকালে কাঁচের জানালা দিয়ে আকাশ আর আলো দেখা যায়। একটা বাসন রাখার আলমারি, একটা ফ্রিজ, দুজনের জন্য টেবিল আর চেয়ার। এটাই আমাদের রুম। খুব সকালে ঘুম ভাঙল হাসানের ডাকে। ‘ওঠেন ওঠেন, আরে হাড়ি, কেটলি কিনতে হবেতো। হারমান ডি ব্রুক্সে নাকি সস্তায় এসব জিনিস পাওয়া যায়।’ হাসান আমার রুমমেট, গতকাল পরিচয় হয়েছে। চট্টগ্রামের ছেলে। ইকলজিতে মাস্টারস করতে এসেছে, তারপর পিএইচডি করার ইচ্ছা। এরমধ্যেই অনেক বন্ধু আর তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে।

নতুন অভিজ্ঞতা হোল হারমান ডি ব্রুক্স মার্কেট দেখে। দোকান সাজিয়ে বসেছে নিজেদের অব্যাবহ্রিত জিনিস নিয়ে।বাটি, প্লেট, ঘড়ি, টিভি, সাইকেল, এমনকি দাদুর ক্ষয়ে যাওয়া হাই পাওয়ারের চশমাটাও। কেউ অভাবে পড়ে বিক্রি করছে না। বিক্রি করলে কিছু আয়, কিছু ফান আর ক্রেতার উপকার। দান করলে কেউ নেবেনা। গ্রীষ্ম এলে গ্যারেজ সেলের ঘটা পড়ে। ফ্যামিলি ফান। বাড়ির সামনের উঠোনে পসরা সাজিয়ে বসে মা, বাবা, ভাইবোন, মামা।

একটা আট নয় বছরের মেয়ে বসেছে একটা কেটলি আর কয়েকটা প্লেট নিয়ে। হাত ঝুঁকিয়ে দাম জানার চেষ্টা করলাম। বলল, ‘সোঁ ফোঁ’। হাসানের দিকে তাকালাম। হেসে বলল, ‘সব মিলিয়ে একশ ফ্রাঙ্ক’। আরও কিছু রান্নার সরঞ্জাম, কাপ গ্লাস ইত্যাদি নিয়ে ট্রামে চাপলাম।

রেজিস্ট্রেশান অফিসে থেকে বলেছিল বিকেলে নবীন বরন অনুষ্ঠানে যেতে। যথাসময়ে গিয়ে দেখলাম একজন এমপি, দুজন টিচার, গুটিকয়েক ছাত্র, আর বিশাল এক টেবিল ভর্তি বিয়ার আর রেড ওয়াইন। হাত মেলাও, কথা বল, যত খুশি ড্রিঙ্ক কর। বাংলাদেশি কাউকে দেখলাম না। বেশিরভাগ চলে গেছে কাজ করতে বা কাজ খুঁজতে। বাংলাদেশের ছাত্রদের পিছনে ফেলে আসা পরিবারের টান প্রবল। উদয়াস্ত পরিশ্রম, মধ্যরাত পর্যন্ত পার্টি, এখানে স্থায়ী হবার বিবিধ লৌকিক অতিলৌকিক চেষ্টা করার পরেও সময় থাকে টাকা পাঠানোর লাইনে দাড়িয়ে থাকার। শরীফ ভাইয়ের জুতোর উপর দিয়ে বাতাস আর নিচ দিয়ে জল ঢোকে। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের লাইনে দাড়িয়ে বলে, ‘বুজলা, জুতাতে কিচ্ছু অসুবিধা লাগেনা। দেখতে খারাপ লাগে এই যা। এইবার মনে হয় ভোরবেলার আর একটা কাজ পাচ্ছি। ভাতিজা অনেকদিন থেকে একটা কালার টিভি চাচ্ছে।’ ভোরবেলায় কাজ, দিনের বেলা স্কুল, রাতের বেলা আবার কাজ। কাজগুলো যন্ত্রণার, শরীর আর মনকে চুষে ফেলে। মনে মনে বলি, ভালো থাকবেন শরীফ ভাই। আশা করি বাড়ির লোক কোনও দিন বুঝবে।

[১] চাঁদে যাওয়ার চুক্তি না করায় নাসার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলেন জেফ বেজস ≣ [১] জুড়ী নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ কৃষকের মানববন্ধন ≣ [১] বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সোনার ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী: স্পিকার
পরের দিন হাসান বলল সামনে যে শীত আসছে তা আমাদের নতুনদের জন্য খুব কঠিন হবে। টাকায় টান পরবে। ছাত্ররা অনেকেই কাজ করতে আরম্ভ দিয়েছে। ঠিক হল পরের শনিবার খুব ভোরে হাসান, হিরেনদা আর আমি যাব জব হান্টিং এ। ভোর চারটায় আমি তৈরি। কেমন করে, কি পরে ইন্টারভিউ দেব কিছুই ধারনা নেই। ইয়োরোপের রাজধানী বলে কথা। কোট টাই তার উপর ওভারকোট চাপিয়ে নিলাম। প্রায় কুড়ি মিনিট হাঁটা তারপর ঘণ্টা খানেকের সাবওয়ে ট্রেন।

তখন ভোরের আলো কেবল ফুটছে। স্টেশন থেকে একটু হেঁটে একটা মাঝারি আকার পার্কের মতো জায়গা, তাতে অনেক মানুষজন। বেশ কয়েকজনের হাতে গাইতি, শাবল, কোদাল ইত্যাদি। হিরেনদা পার্কে ঢুকেই ‘থাবাই মশিয়ু, থাবাই মশিয়ু ‘ বলতে বলতে এদিক থেকে ওদিকে ছুটছে। হাসানও পেছন নিল একই সুরে। ওভারকোটের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে টাই খুলে পকেটে পুরলাম। পোশাকের কারণে নিজেকে ধিক্কার দিলাম মূর্খ স্নব বলে। তারপর হাসানের পিছন পিছন থাবাই মশিয়ু ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এর মানে কি। ‘আরে মানে পরে বুঝবেন, এখন বলেন’। তিনজন স্লোগান দিতে দিতে এমাথা ওমাথা করছি। কিছুক্ষণ পরে দাদাকে কে যেন নিয়ে গেল। আমাদের কপালে কি আছে।

একজন হাতের ইশারায় আমাদের দুজনকেই ডাকল। টান টান, ছয় ফুট, ফ্রেঞ্চকাট, মাথায় ফেডোরা হ্যাট, এই টারজানের বাড়ী লিমবুর্গ। ব্রাসেলস থেকে প্রায় একশ আশি কিলোমিটার। শুনেছি চারিদিকে কত রকমের ফলের বাগান, আপেল, পিয়ার, আঙুর। ছবির মতো শহর। ওখানে আমাদের সাতদিনের জন্য নিয়ে যাবে। পনের হাজার ফ্রাঙ্ক আর থাকা-খাওয়া ফ্রী। সারাদিন ফলের বাগানে ঘুরে ফল তুলে বেড়াব। টারজান ওর পার্টনারের সাথে কথা বলতে চলে গেল।

আমি বেশ উত্তেজিত। ফল পাড়াতো দুরে থাক, কোনদিন আপেল গাছই দেখিনি। ছবিতে দেখেছি আঙুর হয় লতানো গাছে। আঙুর ফল থাকে শাহবাগ এর কোনায়, হসপিটালের পাশে। রোগী আর অসুখের গ্রেড বুঝে ফল নিয়ে যাওয়া হয়। মরার সম্ভাবনা থাকলে আঙুর পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আম, কমলাতে তেমন ভয়ের কিছু নাই। কিন্তু চোখ খুলে মাথার পাশে আঙুর দেখলে রোগীর হৃদকম্পন শুরু হয়। খোলা আকাশের নীচে আঙুর আর আপেল গাছের সাড়ির মাঝখানে নিজেকে কল্পনা করি।

হাসান আরও উত্তেজিত। ‘জানেন, টাকাটা এখন আমার বিশেষ দরকার ছিল। খুব চিন্তায় ছিলাম। এখন তিন চার মাস ভালোই কেটে যাবে।’
আবার হবু বসের ইশারা পেয়ে কাছে গেলাম। বলল, সরি । আমার শরীর, পোশাক কোনটাই কাজের উপযোগী নয়। আমার বদলে আর একজনকে পেয়েছে। হাসানকে একটা পিক আপ ভ্যান দেখিয়ে ওটাতে চড়তে বলল।

রাত জাগার ক্লান্তি, উত্তেজনার ফাঁকি, অবসাদ ঘিরে ধরেছে আমাকে। পার্কের ভেতরেই ছোট্ট একটা পুকুরের পাশে একটা বেঞ্চে বসলাম। ফেরার রাস্তাও ঠিক জানিনা। মনে মনে কল্পনা করলাম লিমবুর্গ এর সন্ধ্যা। আপেল গাছের পাতাগুলো নুয়ে পড়ছে, গাছের ফাঁক দিয়ে একটা দুটা তারা আর চাঁদের আভাস। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ। হাসানের ভাগ্যে হিংসে হল। দুজন একসাথে গেলে বেশ মজা হত। পাশে কে যেন বসল। অবাক হয়ে দেখলাম হাসান। কি বাপার, গেলেন না? ‘নাহ। ভাবলাম মেঘলা দিন, ঘরে গিয়ে খিচুরি আর ডিম ভাজা করি।’ কিন্তু এতগুলো টাকা, সামনে কঠিন শীত। ‘আরে একটা কিছু হয়ে যাবে। এখন তাড়াতাড়ি চলেন। দশ মিনিটের মধ্যে একটা ট্রেন আছে। ধরতে না পারলে আবার দুঘণ্টা বসে থাকতে হবে। একটু জোরে হাঁটতে হবে।’