২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, দুপুর ১২:১৫
শিরোনাম:

ড. সুভাষ দাশগুপ্ত: “বাকশাল” বিশ্লেষণ ও বঙ্গবন্ধু 

ড. সুভাষ দাশগুপ্ত: বাঙালী জাতিকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে এক উন্নত জীবনের সন্ধান দেয়া ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি। তাঁর দর্শন শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির রূপরেখা ও তার বাস্তবায়নের কৌশল এবং পদ্ধতি, তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে অর্ন্তভূক্ত। এখানেই আমরা দেখতে পায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যান্য অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর চিন্তার তফাৎ।

স্বাধীন বাংলাদেশে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদী চেতনা, সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের বৈষম্যহীণ সাম্যবাদ, অংশীদারিত্বমূলক সংসদীয় গণতন্ত্র ও সম্পূর্ন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর “সোনার বাংলা” নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বৃটিশ ও পাকিস্তানি শাসনের প্রতি তাঁর কোন অনুকূল মনোভাব ছিল না। তিনি বৃটিশ, ভারত ও পাকিস্তানের সাংবিধানিক আদর্শে ও বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর চিন্তাধারার মূল উপাদান ছিল বাঙালি সমাজের ঐতিহ্যগত চেতনাবোধ। তিনি এই সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে বাংলাদেশের জন্য এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রয়োজন যেখানে সাধারণ মানুষ সেই রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদার হতে পারবে।

স্বাধীনতা অর্জনের তিন বছরের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন দেশীয় গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমাদৃত হতে থাকে। বিদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর তেজোদীপ্ত ঘোষণা “ পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত: শোষক এবং শোষিত- আমি শোষিতের পক্ষে”। বঙ্গবন্ধুর পূর্বে, স্বল্প- উন্নত দেশের কোন রাষ্ট্র প্রধান বিদেশের মাটিতে দাডিয়ে, এ কথা বলতে পারেননি। তিন বছরের মধ্যে তিনি ১২৫ টা দেশের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাঁর অংশগ্রহণ, আর্কষনীয় ব্যক্তিত্ব ও ভাষণ,  আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙবন্ধুকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারী, সরকারের দায়িত্ব নেয়ার অল্প সময়ের মধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন যে, বৃটিশ ও পাকিস্তান ধাঁচে গড়া আমলাতন্ত্রের দ্বারা সাড়ে সাতকোটি লোকের কাছে সরকারী সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয়। এদের সাথে আরও যোগ হয় প্রশাসনে ছদ্মবেশে কর্মরত স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এই রকম পরিস্হিতি বজায় রেখে তাঁর সোনার বাংলা নির্মাণ কিছুতেই সম্ভব নয়। বঙবন্ধু তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে কোনভাবেই সময়ের অপচয় করেননি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পরদিন থেকে তিনি প্রকাশ্যে পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনার কাজ হাতে নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দুই বছরের ও কম সময়ের মধ্যে তিনি জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান স্বাধীন হবার নয় বছর ( ১৯৪৭-১৯৫৬) পর তাদের সংবিধান তৈরি হয়।

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন দীর্ঘ সময়ের  বৃটিশ শোষণ, ২৩ বছর পাকিস্তানের চরম নির্যাতন ও ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে, পাকিস্তানীদের পোডামাটি নীতি গ্রহণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, স্বাস্হ্য ও শিক্ষার হাল শোচনীয় হয়ে যায়।সর্বত্র ধ্বংস ও অনুন্নয়নের ছাপ। অন্যদিকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ফলে জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে জনগণের পাওয়ার দাবী বাড়তেই থাকে। বাস্তব অবস্থা ও প্রয়োজনের দিকে নযর রেখে, বঙ্গবন্ধু  ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির মাধ্যমে অগ্রগতির ধারণাকে হাতিয়ার করেন। কিন্তু দেশের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ এই ধারনা বাস্তবায়নের অনুকুলে ছিল না।

এ রকম পরিস্হিতি থেকে যত দ্রুত সম্ভব উত্তোরণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু “বাকশাল” গঠন করেন, যা কার্যকর হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারী। বাকশাল বঙ্গবন্ধুর কোন রাজনৈতিক মতবাদ ছিল না। এটা ছিল রাজনৈতিক কৌশল। কৌশল, মতবাদের মত কোন দীর্ঘস্হায়ী বিষয় নয়। এর স্হায়ীত্বকাল স্বল্গকালীন । স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি যে ১৯৬৫ সালে ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, এই সবই ছিল তাঁর রাজনৈতিক কৌশল, এবং রাজনৈতিক মতবাদ অথবা দর্শন নয়। এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই, ১৯৬৫ সালে ৬ দফা ঘোষণার ৫ বছরের মাথায় তিনি বাঙালী জাতিকে স্বাধীন করেন। একই পদ্বতি অনুসরণে তিনি সোনার বাংলা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।

বাকশাল একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ঔপনিবিশবাদ থেকে মুক্ত হওয়া গেলে ও তাদের প্রেতাত্মা থেকে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের থেকে অস্ত্র পরিচালনার ট্রেনিং নিয়ে এরা ভয়ংকর জঙ্গিরূপে আবির্ভুত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এরা ২৬ শতাংশ ভোট পাই এবং এরা কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। দেশ স্বাধীন হবার পর এদের সাথ যোগ দেয় প্রশাসনের একাংশ। প্রকৃত অর্থে এরাই হয়ে উঠে বিরোধী দল। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া প্রাধান্য থাকলেও বঙ্গবন্ধু কখন ও স্বাধীনতাপন্থী অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যতই ক্ষুদ্র দল হোক না, তাদের হেয় করে দেখেননি। প্রায় সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব দেশ গড়ার কাজে অবদান রাখার ইচ্ছা থেকে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন।বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বঙবন্ধু “জাতি গঠন” এবং “রাষ্ট্র গঠন” – এই দুই কাজেই সাধারন মানুষের অংশীদারিত্ব ও সমন্বয় সাধন করে, জাতিকে দ্রুতগতিতে উন্নতির উচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যদি বাকশাল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকত, তবে বিংশ শতাব্দীর শেষে অথবা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের ভিতর বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা পেত।

বঙ্গবন্ধু বাকশাল-কে কখন ও চরম বা চিরকালীন ব্যবস্থা মনে করেননি। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ, এই প্রক্রিয়ায় সমাজের সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে কৃষক ও শ্রমিক শেণির অংশ গ্রহণ এবং প্রত্যেক স্তরে (জাতীয় থেকে স্হানীয়) নির্বাচিত প্রতিনিধি ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা তার প্রধান লক্ষ্য ছিল। যুদ্ধত্তোর পরিস্থিতির বাস্তবতায় এর থেকে কোন স্বল্পকালীন বিকল্প বাঙালীর কাছে ছিল না।

লেখক: প্রাক্তন সিনিয়র টেকনিকাল অফিসার, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা