১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৯:২১
শিরোনাম:

ড. সুভাষ দাশগুপ্ত: ধান চাষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ও ভর্তুকি প্রসংগ

ড. সুভাষ দাশগুপ্ত: বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৮ সালের মধ্যে চাল উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে ১ম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩/৭৪—১৯৭৭/৭৮) অনুমোদন করে ১৯৭৩ সালে। দাতা সংস্হাদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও, বঙ্গবন্ধু ৪৫৫৫ কোটি টাকার মোট বাজেটের মধ্যে, ৬৮৬ কোটি টাকা বরাদ্ধ রাখেন ভর্তুকি বাবদ, যা মোট বাজেটের ১৫.১ শতাংশ। এই ৬৮৬ কোটির মধ্যে ১২৫ কোটি ছিল সার, উন্নত জাতের বীজ ও কীটনাশকের জন্য। উল্লেখ্য, সেচের ভর্তুকি ছিল এই বরাদ্দের বাইরে। সবচেয়ে বেশী ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল সারের বাবদ।

১ম বছর (১৯৭৩/৭৪), বোরো মৌসুমে উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষের জন্য হেক্টর প্রতি মোট রাসায়নিক সারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০০ কেজি (ইউরিয়া-৬৭, টি এস পি- ৩০, পটাশ-৩ কেজি)। আউস ও আমন মৌসুমে উচ্চফলনশীল জাতের জন্য হেক্টর প্রতি ছিল ২৭ কেজি (ইউরিয়া-১৩, টি এস পি-১১, পটাশ- ৩ কেজি)। স্হানীয় জাতের জন্য সারের মাত্রা ছিল খুবই কম। ১৯৭৩/৭৪ সালে মোট সারের চাহিদা ছিল ৫ লক্ষ ২০ ০০০ টন (ইউরিয়া-৩০১, টি এস পি-১৫৮, পটাশ- ৬১ হাজার টন)। সার ব্যবহারের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০/২১ সালে ছিল ৫২ লক্ষ ১০ হাজার টন (ইউরিয়া, ডিএপি, টি এসপি ও পটাশ)। কম ব্যবহারকৃত সার এর সঙ্গে যোগ করলে মোট সার ব্যবহারের পরিমান ছিল প্রায় ৫৫ লক্ষ টনের সমান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ১ কেজি সারে প্রায় ২৭ কেজি ধান উৎপাদন হত, ২০২০/২১ সালে হয় ৭ কেজির ও কম।

২০২০/২১ সালে, প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশের ভিতর সবচেয়ে বেশী রাসায়নিক সার ব্যবহ্নত হয় ভিয়েতনামে (৪১৫.৩০ কেজি/হে:); ২য় স্হানে ছিল চীন (৩৯৩.২০ (কেজি/হে:) এবং ৩য় স্হানে ছিল বাংলাদেশ (৩১৮.১৫ কেজি/হে:)। ভারতে ব্যবহার করা হয় ১৭৫ কেজি/হে:। ধানের জমিতে পৃথিবীব্যাপী গড়ে ব্যবহার হয় ১৩৬.৮ কেজি প্রতি হেক্টরে, দক্ষিণ এশিয়ায়- ১৭০.১০ কেজি।

দেশে ২০২০/২১ সালে মোট ২৪ লক্ষ ৬৩ হাজার টন ইউরিয়া সার ব্যবহৃত হয়, এর মধ্যে ১০ লক্ষ ৩৪ হাজার টন দেশে উৎপাদিত হয়। এবং বাকী ১৪ লক্ষ ২৯ হাজার টন আমদানি করা হয়। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ইউরিয়া সারের আমদানি মোট ইউরিয়া ব্যবহারের মাত্র ২৭ শতাংশ, আর বাংলাদেশ আমদানি করতে হয় প্রায় ৫৭ শতাংশ।ডিএপিতে যে নাইট্রোজেন থাকে তা যোগ করলে আমদানির পরিমানের হার আরো বাডবে। বাংলাদেশে মোট সার ব্যবহারের প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ আমদানি করতে হয়। দ্রুততর সময়ে কিভাবে ইউরিয়া সারের আমদানি শুন্যের কোঠায় আনা যায় তার জন্য ভারত সরকার বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হল বৃহৎ আকারের ইউরিয়া ইন্ডাষ্ট্রি স্থাপন।

দেশে বিগত বছর (২০২০/২১) যে মোট ৫৫ লক্ষ টন সার ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে প্রায় ৪২ লক্ষ ৬৩ হাজার টন ব্যবহৃত হয়েছে ধানের জমিতে। বাকী ১২ লক্ষ ৩৭ হাজার টন ব্যবহ্নত অন্যান্য সব ফসলে- যার সংখ্যা ১০০ -র ও অধিক।

মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে মাতারবাড়ী, বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৫৭.৩৮ শতাংশ কাজ শেষ ≣ রাজিব নূর: বিশ্ববিদ্যালয়ে নাপিত নিয়োগ দিলে যা হয় ≣ [১] চট্টগ্রাম নগরীতে ২৫ লাখ টাকার ক্ষতিকর জর্দা জব্দ
একদিকে ধান চাষে সারের ব্যবহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ধানের ফলন (হেক্টর প্রতি কত টন ধান উৎপাদন হয়) ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ধানের ফলন ক্ষমতা হ্রাসের প্রবণতা দেখা দেয় গত শতাব্দীর ৯ম শতকের (১৯৮১/৮২–১৯৯০/৯১) থেকে। ঐ দশকে ফলন বৃদ্ধির হার ছিল ২.৬৪ শতাংশ। সেই বৃদ্ধির হার বিগত দশকে (২০১১/১২–২০২১/২২) নেমে আসে ০.৮৮ শতাংশে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এস ডি জি- র শেষ বছর (২০৩০ সাল) যে প্রায় ৪৪ মিলিয়ন টন চালের চাহিদা দেখা দিবে সেই পরিমান চাল দেশে উৎপাদন করার সম্ভাবনা খুব ক্ষীন বলা যায়।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, ফলন বৃদ্ধির মাত্রা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাবার পর ও কেন কৃষকেরা জমিতে প্রতি বছর বর্ধিত হারে সারের ব্যবহার করে? দুইটা অন্যতম কাবণ হল: ১. ফলন বৃদ্ধি না হলেও, যাতে করে অন্তত গত বছরের থেকে কম ফলন না হয় এটা নিশ্চিত করার জন্য তাদের বাধ্য হয়ে পরর্বতী বছর বেশী সার জমিতে দিতে হয়; ২. জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে করে ধান গাছ, জমি থেকে নাইট্রোজেন গ্রহনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে বলা প্রয়োজন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে ধান গাছ যে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করে, তা ফলন বৃদ্ধিতে কোন সহায়ক ভূমিকা রাখেনা, বরং আরো ক্ষতি করে। অন্যদিকে, ভবিষ্যতে কৃষকদের আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও তাদের জমিতে সারের প্রয়োগ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোন পথ আপাতত খোলা নেয়। এছাড়াও, অব্যাহতভাবে ধান/চালের মুল্য বৃদ্ধি পেতে থাকলে কৃষকদের মধ্যে সারের মাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়।

বিশ্বে বছরে গড়ে প্রায় ইউ এস ডলার ৭০০ বিলিয়ন কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া হয়। এত বিশাল অংকের ভর্তুকির পিছনে কারনগুলির অন্যতম হল ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রয়োজনে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা, কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করা এবং চালের বাজার সাধারন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভিতর রাখা। বাংলাদেশে, এই তিনটি উপসর্গতেই সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

ভারতে সারের ওপর ভর্তুকির পরিমান ১০০ কোটি রূপির ও বেশী। এই বিশাল পরিমানের ভর্তুকি, সরকারের জন্য কোন বোঝা নয় বরং লাভ, তার কারন হচ্ছে ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামকে পিছনে ফেলে বিশ্বে এক নম্বর চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে এবং এই অন্চলে সবচেয়ে কম খরচে চাল উৎপাদন হয় ভারতে। এও উল্লেখ্য যে, ভারতে চালের গড় ফলন বাংলাদেশ থেকে কম। গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে, কিভাবে সারের ভর্তুকি আরও কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করা যায় এবং ভর্তুকি বৃদ্ধির সনাতনী ধারণা থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসা যায় সেদিকে প্রাধান্য দিতে হবে।

লেখক: প্রাক্তন সিনিয়র টেকনিকাল অফিসার, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা