২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সন্ধ্যা ৭:০০
শিরোনাম:

‘চেতনা’র প্রলোভনে পা দিয়ে গ্রাহকদের ৩শ কোটি টাকা হাওয়া

ঢাকার আশুলিয়ায় লাপাত্তা হয়ে যাওয়া ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে’র সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। মঙ্গলবার (২২ মার্চ) রাতে র‌্যাব-৪ এর একটি দল আশুলিয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন ইকবাল হোসেন সরকার (৩৫), মাজহারুল ইসলাম (৩৫), মমিন হোসেন (৩৫), জাহাঙ্গীর আলম (৩৫), ইব্রাহিম খলিল (৩৫), এস এম মকবুল হোসেন (৪০), মিজানুর রহমান (৩৮), আল আমিন হোসেন (২৮), ফজলুল হক (৩৫) ও নুর হোসেন (২৭)।

বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, সম্প্রতি আশুলিয়া এলাকার শতাধিক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় অবস্থিত চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে গেছে।

জমাকৃত টাকা ফেরত পেতে গত ১৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির জামগড়া অফিসের সামনে মানববন্ধন করেন প্রায় ১ হাজার গ্রাহক।র‌্যাব এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে এবং বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।

র‌্যাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ৩০ সদস্য বিশিষ্ট গভর্নিং বডি নিয়ে চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর-১৯৩। প্রথমদিকে তারা স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের মানুষকে অধিক মুনাফায় সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণের প্রতি আকৃষ্ট করত। ধীরে ধীরে বড় পরিসরে কাজ শুরু করে তারা। ব্যাংকের মতো সঞ্চয়ী পলিসি, এফ ডি আর, ডিপিএস, পেনশন পলিসি, শিক্ষা পলিসি, হজ্ব পলিসি, রিয়েল এস্টেট ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিনিয়োগ নেওয়া শুরু করে তারা। এক্ষেত্রে তাদের মূল টার্গেট ছিল আশুলিয়া ও সাভারের শিল্প এলাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা।

ভিকটিমদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সংস্থাটি গ্রাহকদের প্রথম দিকে কয়েক মাস চুক্তি অনুযায়ী লভ্যাংশ দিত। যা দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হতো। বেশি লাভের আশায় অনেকে নিজের পেনশনের টাকা, গ্রামের ভিটেবাড়ি বিক্রি করা টাকা, বিদেশ থেকে কষ্ট করে অর্জিত অর্থ ওই সমিতিতে জমা রাখত। তবে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৬ মার্চ অফিসে তালা দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় কোম্পানিটি।

মোজাম্মেল হক বলেন, অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘চেতনা’র অংশীদাররা বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে জমি কেনা, বহুতল ভবন নির্মাণ এবং ছোট-বড় কিছু কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে তারা।

সমিতির সহ-সভাপতি পলাতক মুহাম্মাদউল্লাহ আশুলিয়ার নরসিংহপুরে বসবাস করলেও তিনি মূলত ভোলার বাসিন্দা। তিনি ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। আশুলিয়াতে তার পাঁচতলা বাড়ি এবং একাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রেফতার হওয়া ইকবাল হোসেন সরকার মুহাম্মাদউল্লাহর বন্ধু এবং সমিতির সহ-সভাপতি।

চেতনা সমিতির প্রধানের সঙ্গে বেশ কিছু ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। তদন্তের মাধ্যমে তাদের নাম-পরিচয় এবং প্রতারণায় কার কী ভূমিকা ছিল তা বেরিয়ে আসবে বলেও জানান র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

সাভার উপজেলা সমবায় কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন মাসে সর্বশেষ অডিট অনুযায়ী এই সমিতির ফান্ডে মাত্র ৬১ লাখ টাকা জমা ছিল।

প্রতারণার কৌশল

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চেতনা সমিতির মাঠ পর্যায়ে অনেক কর্মী ও সদস্য রয়েছে। তারা আশুলিয়া, সাভার ও ধামরাই এলাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ, গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ীসহ নিম্ন আয়ের মানুষদের টার্গেট করত এবং লাখে ১ থেকে ৩ হাজার টাকা মাসিক লাভসহ নানা উপায়ে স্বল্প সময়ে আরও অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখাত। মানুষকে প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন প্রজেক্ট, গাছের বাগান, ডেইরি ফার্ম, ফ্ল্যাট ও প্লটের মালিক হওয়ার প্রলোভনও দেখানো হতো। এফডিআর করলে এক লাখে মাসে ১৮শ টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথাও বলা হয়।

টাকা সংগ্রহে ভয়ভীতি প্রদর্শন

কোম্পানির সদস্যরা মাসিক বা পাক্ষিক ভিত্তিতে সদস্যদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করত। নিয়মিত টাকা না দিলে জরিমানা করা হতো। এছাড়া টাকা না দিলে মেয়াদ শেষে মুনাফা কম পাবে- এমন ভয় দেখানো হতো। এমনকি করোনাকালীন সময়েও খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে সমিতিতে নিয়মিত টাকা দিয়েছেন অনেকে।

প্রতারণায় ‘শরিয়া’ কৌশল, জমি ব্যক্তির নামে

চেতনা সমিতি বলত তারা ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। তাদের প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখলে তা সুদ হবে না, বরং ইসলামি ব্যবসার আদলে গ্রাহক সঠিক উপায়ে মুনাফা পাবেন- এমনটা প্রচার করত। এসব কথা বলে তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বোকা বানাত।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা সমিতির নামে রেজিস্ট্রেশনের কথা থাকলেও তা রেজিস্ট্রেশন করা হয় সভাপতি মুহাম্মাদউল্লাহসহ কয়েকজনের নামে।

২০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তিতে ফ্ল্যাট বরাদ্দের লোভনীয় অফার দেয় এ সমিতি। আশুলিয়ার গণবিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ঘোড়াপীর প্রকল্পে তাদের অনেক জমি রয়েছে এবং সেখানে ভবন করে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে বলে গ্রাহকদের জানায় তারা। যদিও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই প্রকল্পে তাদের ব্যক্তি নামে মাত্র ১০ শতাংশ জমি ছিল, যা ইতোমধ্যে বিক্রি করা হয়েছে।

‘চেতনা ‘র পাশাপাশি তারা আরও তিনটি নামসর্বস্ব কোম্পানি চালু করে। চেতনা পরিবার, চেতনা গার্ডেনিয়া (রিয়েল এস্টেট ব্যবসা) ও চেতনা পরিবার কল্যাণ ফাউন্ডেশন। যদিও এই তিন কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সমিতির ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তোলন করে অন্যত্র নিজেদের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করত তারা। একইসঙ্গে জমি বা ফ্ল্যাট কিনে টাকা লেয়ারিং করত চেতনার শীর্ষ স্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা।