২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ১০:২৭
শিরোনাম:

সৌদি পাঠানোর নামে ঢাকায় এনে ধর্ষণ, গ্রেফতার ৪

সৌদি আরব পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে গত ১২ এপ্রিল মৌলভীবাজার থেকে একজন নারীকে ঢাকার রামপুরায় ডেকে আনেন মানবপাচার চক্রের অন্যতম হোতা কামরুল আহম্মেদ। রামপুরার একটি বাসায় ওই নারীকে আটকে রাখা হয়। এরপর কামরুলের সহযোগী তোফায়েল ওই নারীকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। তাতে তিনি রাজি না হওয়ায় জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়। একপর্যায়ে ওই নারী মোবাইল ফোনে র‌্যাবের কাছে সাহায্য চাইলে র‌্যাবের একটি দল ১৩ এপ্রিল রাতে অভিযান চালিয়ে ভুক্তভোগী নারীকে উদ্ধার করে।

পরে রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকা থেকে সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের হোতাসহ চার সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।গ্রেফতাররা হলেন- কামরুল আহম্মেদ (৪২), খালেদ মাসুদ হেলাল (৩৬), তোফায়েল আহম্মেদ (৩৮) ও মো. জামাল (৪২)।

গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ২৭টি পাসপোর্ট, একটি মনিটর, একটি সিপিইউ, একটি মাউস, একটি কিবোর্ড, একটি ইউপিএস, ১০০টি ভুয়া ভিসার কপি, ১২৫টি ভুয়া টিকিট, চারটি মোবাইল ফোন এবং একটি প্রিন্টার উদ্ধার করা হয়।

শনিবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহম্মেদ।

তিনি বলেন, একজন ভিকটিমের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ জানতে পারে রামপুরা এলাকায় একটি মানবপাচার ও প্রতারক চক্র মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া ভিসা ও টিকিট দিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বেকারদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগীরা ভুয়া ভিসা ও টিকিট বিমানবন্দরে দেখানোর পর ইমেগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের ভিসা ও টিকিট জাল হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এরকম কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি দল গোয়েন্দা নজরদারি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে। ১২ এপ্রিল চক্রটি মৌলভীবাজার থেকে একজন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে রামপুরা এলাকার কামরুলের বাসায় নিয়ে আসে। ওই বাসায় নারীকে আটকে রেখে তোফায়েল ধর্ষণ করে। ওই নারী মোবাইল ফোনে র‌্যাবের কাছে সাহায্য চাইলে র‌্যাবের একটি দল ১৩ এপ্রিল রাতে অভিযান চালিয়ে ওই নারীকে উদ্ধার করে।

ভিকটিমের বরাত দিয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ভিকটিম সাইফুল ইসলাম শান্ত নামে একজনকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর সাইফুল যৌতুক বাবদ ভিকটিমের কাছ থেকে ধাপে ধাপে ৫ লাখ টাকা আদায় করে তাকে ছেড়ে চলে যায়। মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে যৌতুকের টাকা ভিকটিমের বাবা মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে জোগাড় করেছিলেন। পাওনাদাররা টাকার জন্য চাপ দিতে থাকলে ভিকটিম তার গ্রামের দালাল তোফায়েলের শরণাপন্ন হন।

ভিকটিমকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ভিকটিমের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তোফায়েল ভিকটিমকে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব পাঠানোর প্রলোভন দেখায়। সৌদি যেতে রাজি হন তিনি। এরপর সৌদি যেতে হলে আরবি ভাষার ট্রেনিং করতে হবে, এ কথা বলে ভিকটিমকে ঢাকায় নিয়ে এসে কামরুলের বাসায় আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভিকটিমকে রামপুরা থানায় পাঠানো হয়। ভিকটিম বাদী হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারক চক্র। তাদের জনশক্তি রপ্তানির কোনো লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারা দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে লোক পাঠাতো। এছাড়াও চক্রটি মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে জনশক্তি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বেকারদের কাছ থেকে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকিট ধরিয়ে দিত।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ভুক্তভোগীরা ভুয়া ভিসা ও টিকিট নিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফিরে এসে আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে আসামিরা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এভাবে গত দুই বছরে আসামিরা আট বার বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে। গত পাঁচ বছরে চক্রটি অবৈধভাবে শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। তারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। চক্রটি শতাধিক ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকিট সরবরাহ করে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

র‌্যাব জানায়, চক্রের হোতা কামরুল নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তার কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। প্রতারণা এবং মানবপাচারই তার পেশা। ২০১৯ সালে সে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যায়। তারপর সেখানে মানবপাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দুবাইয়ের রেসিডেন্স ভিসা লাভ করে এবং একটি প্রাইভেটকার কিনে নিজে ড্রাইভিং করে অর্থ উপার্জন করে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে সে প্রাইভেটকারটি বিক্রি করে ২০২১ সালের মে মাসে দেশে ফিরে এসে পুনরায় প্রতারণা এবং মানবপাচার শুরু করে। তার জনশক্তি রপ্তানির কোনো লাইসেন্স নেই। সে বিভিন্ন টুরস ও ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসায় বিভিন্ন দেশে লোক পাঠাতো।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, ভুয়া টিকিট সরবরাহ করে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোকের কাছ থেকে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কামরুলের নামে চট্টগ্রাম কোর্টে একটি চেক জালিয়াতির মামলা এবং মৌলভীবাজার কোর্টে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ১৮ লাখ টাকার একটি মামলা রয়েছে। তার বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে ৩৮ লাখ টাকার উপরে আছে বলে জানায়।