২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৪:০৪
শিরোনাম:

স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী আনোয়ারের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ

বিশেষ প্রতিনিধি : স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টেন্ডার জালিয়াতি, নিন্মমানের কাজ ও অনিয়মের মাধ্যমে বিল তুলে নেয়া সহ নানা কায়দায় হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন। সম্প্রতি এনিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগও জমা পড়েছে।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সবচেয়ে বেশী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিগত সময়ে নতুন নতুন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ, জেলা উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালের কার্যক্রম সম্প্রসারনসহ উপজেলা পর্যায়ে প্রায় চার শতাধিক কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়। এসব কাজের মান নিয়ে স্বয়ং সংস্থার প্রকৌশলীদের মধ্যেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। শুধু তাই নয় সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর দুর্বলতার সুযোগে সংস্থার তৃণমূল পর্যায়ে অনিয়ম দুর্নীতি লাগামহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আবদুল হামিদ ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনসহ দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের সমন্বয়ে গড়ে উঠে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানা যায়, ইজিপির আওতায় টেন্ডারে সুক্ষ্মভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে। ধূর্ত ও চতুর কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন অপকৌশল প্রয়োগ করে কার্যাদেশ দিয়ে থাকেন। এইভাবে আনোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন যাবত প্রধান কার্যালয়ের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। যার ফলস্বরূপ তার পছন্দের কয়েকজন ঠিকাদারকে ঘুরেফিরে কাজ পাইয়ে দেন। বিনিময়ে পকেটস্থ করেন ১৫শতাংশ হারে কমিশন। যা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে এখন ওপেন সিক্রেট।

অভিযোগ রয়েছে, টেন্ডার মূল্যয়ন কমিটির সভাপতি হওয়ার সুবাধে স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে তার নিজের শ্বশুরের মেসার্স নূরানী কনস্ট্রাকশন লি: কে কাজ পাইয়ে দেন, সর্বশেষ তিনি টাঙ্গাইল জেলায় ৩৬ কোটি টাকা ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি নির্মাণ কাজটি তার শ্বশুলের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নূরাণী কনস্ট্রাকশন লি: কে দিয়েছেন আর এদিকে, নূরাণী কনস্ট্রাকশন লি: ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মহাখালীর স্বাস্থ্য ভবন নির্মাণ কাজে প্রথম পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। ঠিকাদারকে ভুয়া বিল দিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা ভাগাভাগি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে চার তলা ভবন নির্মাণে প্রায় ৩৪ কোটি টাকা কার্যাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু ভবনটির কলাম, বিম ও ছাদ ঢালাই করে ভুয়া পরিমাপ দিয়ে সমুদয় টাকা ব্যয় করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্তে কোটি কোটি টাকা ভুয়া বিল প্রদানের বিষয়টি ধরা পড়ে। ভবনটির নির্মাণকাজ চলাকালীন সময় সিটি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন,এইচইডি প্রধান কার্যালয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন। তার তত্ত্বাবাধানে এই কাজটি সম্পর্ণ হয় এবং তিনি বিলে স্বাক্ষর করেন।

অভিযোগ আছে, মাঠ পর্যায়ে যে সব প্রকৌশলী এসব পুকুর চুরি করেছিলেন তার দায় তাদের ওপর চাপানো হয়নি। উল্টো তাদেরকে পদোন্নতি দিয়ে প্রধান কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মহাখালীতে স্বাস্থ্য ভবন নির্মাণে প্রথম ধাপের ২৯ শতাংশ কাজ করেই শতভাগ বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অবশিষ্ট ৭১ ভাগ কাজ শেষ করতে অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এইচইডি)।

এই ভবন নির্মাণের প্রথম ধাপে ৮৬৬ ধরনের কাজের জন্য মেসার্স বিবি অ্যান্ড ইউসিসি (জয়েন্ট ভেঞ্চার-জেভি) ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দৃশ্যমান অবকাঠামোর ৬০৩ ধরনের কাজও করেনি তারা। খোদ এইচইডির তদন্তে এমন ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, পূর্ত, সেনিটারি ও পানি সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি এবং আনুষঙ্গিক কাজে সর্ব নিম্ম দরদাতা হিসেবে ৩৩ কোটি ৯২ লাখ টাকার কার্যাদেশ পায় মেসার্স বিবি অ্যান্ড ইউসিসি। এরপর চুক্তিভুক্ত ২৫৩ ধরনের কাজ করেই শতভাগ বিল তুলে নেয়। অর্থাৎ তারা মাত্র ২৯ শতাংশ কাজ করেছে। অথচ পুরো বিল প্রায় ৩৪ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে।

এইচইডির এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের পর পুরো বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যেসব আইটেমের কাজ বাকি ছিল সেগুলো আলাদা দরপত্র আহ্বান করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করানো হয়েছে। সেখানে এইচইডির অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

স্বাস্থ্য ভবন নির্মাণের প্রথম ধাপের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে এইচইডি। কমিটির প্রধান করা হয় তৎকালীন এইচইডির সার্কেল-৩ রাজশাহীর (বগুড়া) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিয়াউল হককে। এই কমিটির অন্য দুজন সদস্য হলেন এইচইডির ঢাকা বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার আলী এবং এইচইডির প্রধান কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রকৌশলী হামিদুল হক খান। প্রায় দুই মাস কাজ করে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিল করেন। কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র ঘেঁটে ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য পায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্য ভবন নির্মাণে অনিয়মের বিষয়গুলো তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অনিয়মের বিষয়গুলো শতভাগ সঠিক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, বেজমেন্ট-১, বেজমেন্ট-২, বেজমেন্ট-৩ এবং ৩য় ও ৪র্থ তলায় আরসিসি ওয়াল, কলাম, বিম ও ছাদের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

চুক্তি অনুযায়ী পূর্তের ২৫৭টি কাজ, সেনিটারি ও পানি সরবরাহে ৬০টি কাজ, অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিকে ৫৫টি কাজ এবং ২১টি আনুষঙ্গিক ৪৯৪টি কাজসহ মোট ৮৬৬টি কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে চুক্তি অনুযায়ী মাত্র ২৫৩টি কাজ হয়েছে। এর মধ্যে পূর্তে ১৭১টি, সেনিটারি ও পানি সরবরাহে ৪১টি, অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিকে ৫১টি কাজ হয়েছে। এর বাইরে চুক্তিবহির্ভূত ১৭টি কাজ বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চুক্তিভুক্ত ৬০৩টি কাজ করাই হয়নি।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভবন নির্মাণে প্রথম ধাপের কাজের দরপত্রে সর্বনিম্ম দরদাতা হওয়ায় বিবি অ্যান্ড ইউসিসির (জেবি) অনুকূলে ২০১০ সালের ২৪ জুন ৩৩ কোটি ৯২ লাখ ১১ হাজার ৮৯১ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। ২০ তলা ভবন নির্মাণে এখন দ্বিতীয় ধাপের কাজ চলমান।

৩৭ কাজের পরিমাপে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকার গরমিল : তদন্ত কমিটি অনুমোদিত নকশা ও সম্পাদিত কাজ অনুযায়ী ৩৭টির পরিমাপ করা হয়। চলতি বিলে এসব কাজে উল্লিখিত পরিমাণের সঙ্গে কমিটি তুলনা করে বড়ো ধরনের গরমিল পেয়েছে। ৩৭টি কাজে মোট ২ কোটি ২৯ লাখ ৮ হাজার ৮৯৩ টাকার পরিমাপ বেশি দেখানো হয়েছে।

এর মধ্যে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মার্বেল স্টোন না বসিয়ে ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৩৪৫ টাকার বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। প্লাস্টারে ফোম ল্যাব ব্যবহারে ৭৭ হাজার ৬০০ টাকার চুক্তি হলেও ১১ লাখ ১৭ হাজার ৫১৪ টাকার পরিমাপ দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে চুক্তির চেয়ে ১৪ গুণ বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। মাটি সরানোর কাজে ৩ লাখ টাকার চুক্তি হয়। অথচ বিলে দেখানো হয়েছে ৪৫ লাখ ৪৩ হাজার ৩২০ টাকা, যা চুক্তিমূল্যের চেয়ে ১৫ গুণের বেশি। বেজমেন্ট-১, ২ ও ৩-এ ডায়াপগ্রামওয়ালের ওয়াল থিকনেস পরিমাপে বেশি দেখানো হয়েছে। এভাবে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৭৬৫ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে।

স্ট্রাকচারাল ফোমিংয়ে জালিয়াতি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩০ টাকা বেশি বিল গ্রহণ করেছে। বেজমেন্ট-১, ২ ও ৩-এ ওয়ালের উচ্চতা বেশি দেখানোসহ অন্যান্য কাজে ২৩ লাখ ৮৩ হাজার ২৪০ টাকা বেশি বিল উত্তোলন করেছে। বেজমেন্ট-৩-এ রড ব্যবহারে বাজারদরের চেয়ে বেশি টাকা ধরে বিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৭১ লাখ ৭৯ হাজার ২৮০ টাকা বেশি বিল তুলে নিয়েছে।
চুক্তিভুক্ত ৬০৩টি কাজ চার কোটি টাকায় সম্পন্ন করা যেত। এসব কাজ এখন বাস্তবায়ন করতে গেলে ৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবশিষ্ট এই কাজ করতে পরে অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

এছাড়াও কুমিল্লা ও চাঁদপুরে তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এরমধ্যে একটি প্রকল্পে ভুয়া বিলে প্রায় ৬০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তিনটি প্রকল্পেই নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে। এপ্রকল্পের তত্ত্বাধানে দায়িত্বে ছিলেন প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন।

এমনকি কোনো প্রকল্পেই নকশা অনুযায়ী কাজ হয়নি। এসব প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে সাহারা এন্টারপ্রাইজ। অথচ প্রকল্প তিনটির কাজ এই প্রতিষ্ঠান পায়নি। অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ বাগিয়ে নিয়ে তারা কাজ করছে। শুধু এই তিনটি প্রকল্পেই নয়, সাহারা এন্টারপ্রাইজ অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে যৌথভাবে (জয়েন্ট ভেঞ্চার-জেভি) কাজ বাস্তবায়ন করছে।

তিন বছরে তারা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এইচইডি) ১৭টি প্রকল্পে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাজ করছে। বড় কাজের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কাজের মান নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। দায়সারাভাবে কাজ করে বেশি বিল তুলে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এইচইডির দুটি পৃথক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এসম্পর্কে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কয়েক দফা চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায় যায়নি, মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।