২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ২:০২
শিরোনাম:

ক্ষমতায় গেলে কুইক রেন্টাল ও বিদ্যুৎ খাতে আইন বাতিল করবে বিএনপি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান দুরবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সর্বগ্রাসী দুর্নীতি’, ‘আত্মঘাতী চুক্তি’ ও ‘অপরিণামদর্শী’ পরিকল্পনাকে দায়ী করেছে বিএনপি। তারা আগামীতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধিতে আইন (বিশেষ বিধান), রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির চুক্তি বাতিল করবেন। একইসঙ্গে দেশের চলমান পরিস্থিতি উত্তরণে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে ১২ দফা পদক্ষেপও তুলে ধরেছে দলটি।

শনিবার (১২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এসময় দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি ও হরিলুটের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। এখন শহরে দু-তিন ঘণ্টা ও গ্রামে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে, যা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির মধ্যে লোডশেডিংয়ে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যুক্ত হয়েছে। মানুষ আজ দিশেহারা, তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।’

ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে সরকারকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের এ বিপর্যয়, রিজার্ভ সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস। এ দায় কাঁধে নিয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে।’

ক্ষমতায় গেলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বাতিল

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ক্ষমতায় গেলে আমরা দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করবো। আশার বাণী হলো- বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবারহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনসহ সব কালা-কানুন বাতিল করবো। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করা হবে। স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। উৎপাদনের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন দ্রুত স্থাপন করা হবে। বাপেক্স ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে দেশীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবো।’

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আমরা বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনাময় গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি, জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর জ্বালানিনীতি গ্রহণ করবো।’

‘বেইস লোড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্পব্যয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন গড়ে তোলা, বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঘোষিত ভিশন-২০৩০-এ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে’ বলেও উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব।

জনগণের সম্পদ লুটই সরকারের নীতি

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে চালুর দু-তিন বছর পরই বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। অথচ প্রয়োজন ছাড়াই সেগুলো এখনো চালু। বেশ কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়াই সরকারকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকার গচ্চা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ গেছে প্রায় ৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। গত তিন বছরেই গেছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা।’

তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার অনেক বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তি করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ সরকারের নীতি একটাই, তা হচ্ছে জনগণের সম্পদ লুট করে নিজের সম্পদ বাড়ানো। আর বিদেশে সেই সম্পদ পাচার করা।’

৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র ফেলে রেখেছে সরকার

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি ৫৭ শতাংশ অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ না কিনে গত অর্থবছরে বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। তার আগে বছর বিল পরিশোধ করা হয় ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ। ক্রমেই ক্যাপাসিটি চার্জের বিল বেড়েই যাচ্ছে।’

ফখরুল বলেন, ‘এখানেই শেষ নয়। বর্তমানে বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। এতে অলস খরচ আরও বাড়বে। বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৫টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক উৎপাদনে আসতে পারে।’

‘নির্মাণাধীন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতে রয়েছে ৯ হাজার মেগাওয়াট। এ কেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য গ্যাসভিত্তিক। এখনই গ্যাস সংকটে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগামী চার বছরে আরও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক বহুগুণ বেড়ে যাবে।’

কুইক রেন্টালের নামে ‘কুইক লুটপাট’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সামিট গ্রুপ, এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, এরদা পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ক্যাট, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি- এ কোম্পানিগুলো কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। কুইক রেন্টালের নামে এসব কুইক লুটপাট করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান জবাবদিহিহীন সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র রেখেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। বসিয়ে বসিয়ে তাদেরকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে যাচ্ছে। এ অর্থ জনগণের। এ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাত দেউলিয়া হচ্ছে। সরকার টাকা চুরির স্বার্থে মাল্টি ফিন্যান্সিং ইনস্টিটিউটের কম সুদের ঋণ উপেক্ষা করে বর্তমানে পারস্পরিক স্বার্থে উচ্চ সুদের বাইলিটারাল লোনে বেশি আগ্রহী।’

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনতে দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এজন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। আদানি গ্রুপের এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা রয়েছে। বাংলাদেশে যখন প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার ক্যাপাসিটি রয়েছে, ঠিক সেসময় ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘১৬০০ মেগাওয়াটের আদানি গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১১ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে। এ বিদ্যুৎ আমদানির ৪০ শতাংশ যায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। বিদ্যুৎ কম এলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। চুক্তির ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানি গ্রুপকে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করতে হবে, যা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু, ৯টি কর্ণফুলী টানেল কিংবা দুটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আদানির এ কোম্পানিকে তিন বছরে ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। অথচ পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতিসহ খরচ পড়েছে ৩০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এ কেন্দ্র থেকে দেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হচ্ছে না এবং হবেও না। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট বোঝা হয়ে আছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে বোঝা

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা না বাড়িয়ে আইপিপির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা অন্যায়ভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ১০ বছরে অফশোর গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়নি। এমনকি বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০ শতাংশ বেশি গ্যাস সরবরাহ করা যেতো। কিন্তু সেটাও করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ভোক্তাদের টাকায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গঠন করা গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে এলএনজি আমদানিতে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ টাকাটা আসলে ঋণের নামে নিয়ে নেওয়া হলো। ভোক্তারা এটিকে বৈধ মনে করে না।’

৫০০০ কোটি ব্যয়ের পরও ‘অলস’ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অদূরদর্শী পরিকল্পনার টিপ অব দ্য আইসবার্গ হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দৃষ্টান্ত। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে গেলেও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু কোনো বিদ্যুৎ না দিলেও এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে চীনা ঋণে বাস্তবায়নাধীন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।’

‘প্রশ্ন হলো- সঞ্চালন লাইনের কাজটি সম্পন্ন করা হলো না কেন? বিদ্যুৎ না কিনেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কেন পরিশোধ করা হলো? অনেকেই মনে করেন, ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুৎ না কিনেও যোগসাজশে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।’