২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:৩০
শিরোনাম:

এসএসসি পাসেই বিআরটি প্রকল্পের ‘সেফটি ইঞ্জিনিয়ার’ জুলফিকার

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যানজট নিরসনে ২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বেড়েছে মেয়াদ। মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে পরিবর্তন হতে থাকে এর জনবল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি (সিজিজিসি) প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব দেয় জুলফিকার আলী শাহকে (৩৯)। জুলফিকার সিজিজিসির বিআরটি প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ২০২১ সালে যোগদান করেন।

এসএসসি পাস জুলফিকারকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ তার কোনো ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক দক্ষতা ছিল না। জুলফিকার প্রকল্পের বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তরার আজমপুর পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি (সিজিজিসি)। সিজিজিসি থেকে ভারি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা ‘থার্ড পার্টি’ প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছে ক্রেন ভাড়া নেয়। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ক্রেনটিও তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া। ওই প্রকল্পের বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা থেকে আজমপুর পর্যন্ত অংশে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলী শাহ। এসএসসি পাস জুলফিকারের কোনো ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক দক্ষতা ছিল না। তারপরও তাকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, দুর্ঘটনার দিনে ভারি গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জুলফিকার কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন ও পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দেননি। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ডিএমপি ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেননি।

এই ধরনের ঘটনা ঘটার পরে কেন এত আলোচনা? দুর্ঘটনা ঘটার আগে সচেতনতা কেন নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, এই ধরনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা উচিত। সেই কাজ তারা করেনি। তাছাড়া এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী থাকা সত্ত্বেও গার্ডার স্থাপনের সময় তাদের নিরাপত্তাকর্মী প্রয়োজন অনুযায়ী ছিল না। ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

দুর্ঘটনাস্থলে দায়িত্বে থাকা চীনা কর্মকর্তাদের কেন গ্রেফতার করা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের এই ঊধ্র্বতন কর্মকর্তা বলেন, একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসবে এই ঘটনায় দায়ী কারা। এছাড়া প্রাথমিকভাবে যাদের দায় রয়েছে বা জড়িত রয়েছেন তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সোমবার (১৫ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডারচাপায় প্রাইভেটকারে থাকা শিশুসহ পাঁচ যাত্রী নিহত হন। এতে আহত হন একই গাড়িতে থাকা এক নবদম্পতি। নিহতরা হলেন- আইয়ুব আলী হোসেন রুবেল (৫৫), ফাহিমা আক্তার (৩৮), ঝর্ণা আক্তার (২৭), ঝর্ণা আক্তারের দুই শিশু সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (৪)। মঙ্গলবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়।

এর আগে, বুধবার (১৭ আগস্ট) রাতে র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১, ৩, ৪, ৬ ও র‌্যাব-১২ যৌথ অভিযান চালিয়ে ক্রেন চালক মো. আল আমিন হোসেন ওরফে হৃদয় (২৫) সহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- রাকিব হোসেন (২৩), দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিকম্যান মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তুষার (৪২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) ও মো. মঞ্জুরুল ইসলাম (২৯)।

বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে প্রাইভেটকারের ওপরে পড়ে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয় এবং দুজন গুরুতরভাবে আহত হন। দুর্ঘটনার পর দ্রুত সময়ে র‌্যাব সদরদপ্তরের উদ্ধার টিম ও র‌্যাব-১ এর একটি দল সর্বপ্রথম উদ্ধারকাজে অংশ নেয়। পরে ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে চার ঘণ্টাব্যাপী উদ্ধারকাজ চালিয়ে যায়।

এসময় র‌্যাবের সহায়তায় অন্য একজন ক্রেন অপারেটর নিয়ে এসে গার্ডার উঁচু করে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি এবং নিহতদের উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে ওই রাতেই রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় বিআরটির অবহেলাজনিত কারণ উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানির (সিজিজিসি) তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে প্রকল্পের গার্ডার উত্তোলনের সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় দায়ী ক্রেনের চালক/অপারেটর মো. আল আমিন ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারি যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পায় ইফসকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যার স্বত্বাধিকারী ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন আজহারুল ইসলাম মিঠু। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারি যন্ত্রপাতি ওঠানামার জন্য ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়াও প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা দিতে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সঙ্গে হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে।

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিন। তার হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর দুই-তিনটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেন আল আমিন। এরপর ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। গ্রেফতার রাকিব তিন মাস আগে এই প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার ক্রেন চালনার কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না।

দুর্ঘটনার দিন আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালনা শুরু করেন। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলনের কারণে ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারায়। এতে গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ওপর ছিটকে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এসময় হেলপার রাকিব ক্রেন চালাচ্ছিলেন। ক্রেন অপারেটর আল আমিন ক্রেনের বাইরে থেকে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন ও হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা আরও জানান, ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারি যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। গার্ডার বহনের ক্রেন এ প্রতিষ্ঠানের কাছে না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর ও হেলপারসহ ক্রেনটি মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকনের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারি গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করেন। এছাড়া গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সেটি ছিল না।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেডের মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেন সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার তুষার ক্রেনের ভাড়া প্রদান, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। গ্রেফতার রুহুল ২০১০ সালে ও তুষার ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছাড়াই অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ দেন। এছাড়াও ক্রেনের সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল ২০২১ সালে। চলতি বছর ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি।

গ্রেফতার রুবেল তিন মাস আগে ও আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিসে ট্রাফিকম্যান হিসেবে এ প্রকল্পে যোগ দেন। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণও ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা সেখানে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।