১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৩:৩১
শিরোনাম:

ডেঙ্গুর প্রকোপ, হাসপাতালে আতঙ্কে নিদ্রাহীন স্বজনরা

রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস এলাকার বাসিন্দা মো. হারুনের মেয়ে নুসরাত (৭) হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়। প্রথমে সাধারণ জ্বর মনে করে ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে মেয়েকে খাওয়ান হারুন। চারদিনের মাথায় জ্বর কমলেও, খাওয়া বন্ধ করে দেয় নুসরাত। মেয়ের শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকায় ৫ অক্টোবর শ্যামলীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান।

প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় নুসরাতের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। চিকিৎসক দ্রুত তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। হাসপাতালের শয্যা খালি না থাকাই নুসরাতের বাবা মেয়েকে সেখানে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হন। মধ্যরাতে মেয়েকে নিয়ে ছুটে আসেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে।

চিকিৎসক নুসরাতের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেন। মেয়ের শারীরিক অবস্থা দেখে আতঙ্কে নিদ্রাহীন রাত কাটান নুসরাতের মা-বাবা। পরদিন রক্তের ব্যবস্থা করে এক এক করে পাঁচ ব্যাগ প্লাটিলেট দেওয়া হয় নুসরাতকে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে।

নুসরাতকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় তার বাবা এ প্রতিবেদককে বলেন, মেয়ের চিন্তায় গত কয়েকটা দিন আমাদের খাওয়া-ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। মেয়ের রক্তের প্লাটিলেট ২৫ হাজারে নেমে গিয়েছিল। রক্ত দেওয়ার পর মেয়ে সুস্থ হয়েছে। এখন মনে একটু শান্তি পাচ্ছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, কেউ যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়ে।

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হসপিটালের যে ওয়ার্ডে নুসরাত ভর্তি ছিল সে ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলে আব্দুল্লাহকে ভর্তি করেন একটি কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ফিরোজ আহমেদ। একদিকে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, অন্যদিকে জ্বরের তীব্রতা না কমায় ছেলের বেডের পাশে বসেই কান্নাকাটি করতে থাকেন ফিরোজ ও তার স্ত্রী।

প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায়, আব্দুল্লাহর রক্তের প্লাটিলেট ১৫ হাজারে নেমে গেছে। দ্রুত আব্দুল্লাহর পরিবারকে রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেন চিকিৎসক। মধ্যরাতে এক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে আব্দুল্লাহকে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ভেঙে পড়েন তার মা-বাবা। সারারাত না ঘুমিয়ে ছেলের পাশে বসে থাকেন তারা।

পরদিন আরও চার ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে আব্দুল্লাহকে প্লাটিলেট দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে সে। ১২ অক্টোবর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় আব্দুল্লাহ।

হাসপাতাল ছাড়ার আগে আব্দুল্লাহর বাবা জাগো নিউজকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে আতঙ্কে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছি। ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরই শুনতে পারি, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পাশের বেডে কোলের শিশুকে নিয়ে এক নারী ভর্তি হয়েছিলেন। শিশুটি সুস্থ হলেও, তার মা মারা গেছে। এমন সংবাদে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। তবে পাশের অন্য বেডের রোগীর স্বজনরা সাহস দিয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শিশুরা দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছে। মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে নিদ্রাহীন থাকছেন। হাসপাতালে এমন পরিস্থিতি বলে বোঝানো যাবে না। সবার মধ্যেই অজানা আতঙ্ক কাজ করছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে ভর্তি করা মিজানুর রহমান বলেন, ছেলের জ্বর আসার পর বাসায় রেখে ওষুধ খাওয়াচ্ছিলাম। কিন্তু তিনদিনেও জ্বর যায়নি, বরং দিন দিন ছেলের অবস্থা খারাপ হয়েছে। পরে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। এখানে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক ভর্তি করতে বলেন।

তিনি আরও বলেন, ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি, কিন্তু মনে শান্তি নেই। ওর যন্ত্রণা দেখে আমাদের খাওয়া-ঘুম সব চলে গেছে। ছেলের চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না। কী যে কঠিন এক সময় পার করছি, বুঝাতে পারছি না।

শুধু নুসরাত, আব্দুল্লাহ বা পাঁচ বছরের ওই শিশুটি নয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন হাসপাতালে শিশুদের ভর্তি করানো হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানী জুড়ে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরের ব্যাপক প্রকোপ দেখা দিয়েছে। শিশুদের পাশাপাশি প্রতিদিন নানা বয়সের নারী-পুরুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ডেঙ্গুরোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। আর হাসপাতালে রোগীর পাশে থাকা স্বজনরা সময় কাটাচ্ছেন আতঙ্কে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২ হাজার ৫১৭ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৯ হাজার ৯৬১ জন। ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের। এ বছর ২১ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ডেঙ্গুরোগীর ব্যাপক চাপ দেখা গেছে। ডেঙ্গুরোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শয্যা খালি না থাকাই হাসপাতালের মেঝেতে রোগী রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মো. মারুফ হোসেন শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, এবার ডেঙ্গুরোগীদের চাপ ভয়াবহ। অনেকদিন ধরেই আমাদের হাসপাতালে শয্যা খালি নেয়। এমতাবস্থায় মেঝেতে রেখে আমরা রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

এবার কোন বয়সীরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শিশুসহ সব বয়সের নারী-পুরুষই এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ঢামেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের এক চিকিৎসক বলেন, এবার প্রচুর শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে। শিশু ওয়ার্ডের কোনো বেড খালি নেই। এক বেডে দুটি শিশু রেখে, এমনকী ফ্লোরে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এরপরও রোগীর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে দ্রুত। প্রেশারও কমে যাচ্ছে। জ্বর ছেড়ে যাওয়ায় পর যখন মনে হচ্ছে রোগী সুস্থ, সে সময় হঠাৎ অবস্থা খারাপ হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

এদিকে সম্প্রতি সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও সংক্রমণ। এ অবস্থায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন ডেঙ্গুরোগীর যে চাপ তৈরি হচ্ছে, তা আপাতত সামাল দেওয়া গেলেও সামনের দিনগুলোতে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে এমনটা ধারণা করা হচ্ছে।

এ কারণে ডেঙ্গুরোগীর সেবাদান নিশ্চিত করতে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও প্রস্তুত রাখতে চাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আহমেদুল কবির বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, যেসব বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গুরোগী ভর্তি নিচ্ছে তারা যেন সরকারি নিয়ম মেনে রোগী ভর্তি করে। কোনোভাবে যেন রোগীদের হয়রানি করা না হয়।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুরোগী কমছে না। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা কখন কত হবে বলা যাচ্ছে না। কোথাও আজকে ১২৩ জন ভর্তি হলো, পরের দিন তা ২০০ জনও হতে পারে। যেহেতু ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়মিত বাড়ছে এবং কোনো রোগী যেন বিনা চিকিৎসায় বাড়ি না ফেরে সেজন্য আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। সেখানে প্রয়োজনীয় জনশক্তি, শয্যা এবং লজিস্টিকস সাপোর্ট রাখা হবে।

তিনি আরো বলেন, এবারের ডেঙ্গুরোগীদের বেশিরভাগের অবস্থায় হঠাৎ করে খারাপ হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আক্রান্ত হওয়ার পাঁচদিন পর রোগী যখন মনে করে সে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে তখনই তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। জ্বর যখনই কমে আসছে, রোগীর রক্তচাপও কমে যাচ্ছে। সে সময়ে তার ভালোভাবে চিকিৎসা করা প্রয়োজন হয়।