১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ভোর ৫:২১
শিরোনাম:

ঘূর্ণিঝড় আমফানের কারণে বিধ্বস্ত এবং বন্যার কারণে চরম ক্ষতির সম্মুখীন একটি গ্রামের কথা

ইমরান হোসেন : ঘূর্ণিঝড় আমফানের কারণে বিধ্বস্ত এবং বন্যার কারণে চরম ক্ষতির সম্মুখীন একটি গ্রামের কথা আমি বলছি। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন এর কাঠমারচর গ্ৰামটি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে সৃষ্ট বন্যায় বিধ্বস্ত।এই মুহূর্তে কাঠমারচর গ্রামটি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ দুর্দশাগ্রস্ত একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। আমি এমন এক গ্রামের কথা বলছি, যে গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষ আজ গৃহহীন। যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আজ রাস্তার উপরে টঙ্ বেঁধে বসবাস করছে। সাইক্লোন সেন্টারের একটি ভগ্ন রুমে একসাথে মানুষ এবং গবাদি পশু এক মানবেতর জীবন যাপন করছে। এখানের নারী এবং শিশুরা এবং পরিবারের বৃদ্ধ মানুষেরা অসম্ভব রকমের অসহায় এক জীবন যাপন করছে। যেখানে মানুষ কোন বেলা খেয়ে এবং কোন বেলা না খেয়ে জীবন যাপন করার কঠিন এক অভিনয়ে মগ্ন। এই গ্রামে ছোট্ট শিশুরা এক প্লেট খিচুড়ি পাওয়ার আশায় বিশাল পানির সমুদ্র পার হতে দ্বিধাবোধ করছে না।


দক্ষিণবঙ্গের প্রায় শেষ সীমানায় অবস্থিত এই গ্রামটি। নদীর একদম কাছে হওয়ায় এই গ্রামটি সবচেয়ে ক্ষতির শিকার। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এর পর ইতিমধ্যেই প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখানের মানুষের দুর্দশাময় পরিস্থিতি দিন দিন আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রতিনিয়তই এখানের মানুষের দুর্দশা সকল কিছুকেই অতিক্রম করেছে। নদীর বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে দীর্ঘদিন ধরে জোয়ার ভাটা চলার কারণে নতুন করে তিনটি বড় বড় খালের সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ৫০ টি পরিবার ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মানুষেরা সত্যিই জানেনা কবে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারবে। এখানে প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের খাবার নেই ,সুপেয় পানি নেই এবং স্যানিটেশন এর বেহাল দশা সব মিলিয়ে তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখিন। এখানে মানুষের জোয়ারের সময় প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে ভাটার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়। এখানের মানুষের প্রতিনিয়তই এক অসম্ভব দুঃসহ জীবন যাপনের চিত্র আমরা দেখতে পাই। এই গ্রামের নারী ও শিশুরা বিষাক্ত লোনা পানির ভিতর চরম অস্বস্তিকর এবং স্বাস্থ্যঝুকিতে দিন কাটাচ্ছে। করনা ভাইরাসের কোন সতর্কতায় তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বেঁচে থাকাটাই তাদের জন্য একটা অসম চ্যালেনজ‌।পানির ভিতর বিষাক্ত সাপ এবং ডায়রিয়া ,কলেরা তাদের জন্য নিত্য নৈমিত্তিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন সন্তানের জননী জরিনা বেগম জানান, তারা রাস্তার ওপর ছোট একটি টঙ বেঁধে গাদাগাদি করে একই পরিবারের নারী-পুরুষ-শিশু এবং বৃদ্ধ একসাথে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা জানেন না কবে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারবেন। রান্না করা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সহ সকল কিছুতেই তারা অত্যান্ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন।পানি অত্যন্ত ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কারণে রাতে তারা কোন রকম মাছ ধরতে পারছেন না এবং কোনো আয়ের এর উৎস তাদের জন্য এই মুহূর্তে নেই।সরকার থেকে খুব সামান্য সাহায্যই তাদের জন্য পৌঁছেছে যেটা তাদের বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত নয়। ঝড় এবং প্রতিদিন চলমান নদীর জোয়ার-ভাটা চলার কারণে তাদের ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র বসবাসকারী নারী-নুরি আক্তার জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে একসাথে অনেক মানুষ তাদের থাকতে হচ্ছে। নারী এবং পুরুষের জন্য আলাদা কোন পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা নেই। উভয়েই বাধ্য হচ্ছেন একটি বাথরুম ব্যবহার করতে। এছাড়া বাথরুমগুলো অপরিষ্কার এবং সুযোগ-সুবিধা হীন। তার পরিবারের সদস্যরা ইতিমধ্যেই নানা সংক্রামক রোগে ভুগছে। তিনি এখনো জানেন না ঠিক কবে তাদের বসতভিটায় ফিরতে পারবেন।

একটা সুস্থ মানুষ হিসেবে যেটা কল্পনা করলেই গা শিউরে ওঠে ঠিক সেরকমই এক পরিস্থিতির মধ্য এখানের মানুষ লড়াই করছে বেঁচে থাকার জন্য।এই গ্রামের মানুষ এই বৃষ্টির এবং শীতের রাতে রাস্তার পরে একটা ছোট্ট টং এর ভিতর বসবাস করছে।সেখানে তাদের টঙের নিচ দিয়ে বয়ে যায় পানির অথৈ সমুদ্র।রাতে ঘুমের ভিতর যদি একটা ছোট্ট শিশু পানিতে পড়ে যায় তাহলে সে আর কখনোই বেঁচে থাকবে না। নিচে সমুদ্রের লোনা পানি এবং ওপরে বৃষ্টির কারণে এই টোঙগুলো বসবাসের জন্য অনেক ভয়াবহ হয়ে উঠছে। একটা অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ জীবন, নারী এবং শিশুদের নিত্য সঙ্গী।

প্রতিটি নারী এবং অসহায় মানুষেরা এখানে প্রতিদিন আশা নিয়ে বসে থাকে কখন তাদের নিকট সামান্য সাহায্য পৌঁছাবে। প্রতিটি পরিবারে চরম ভাবে অভাব কষ্টের দিন কাটাচ্ছে।মানুষ এক অনিশ্চিত জীবন-যাপনের কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। জীবন এক মারাত্মক ঝুঁকি এবং চরম অনিশ্চয়তার বেড়াজালে বন্দি। এখানের মানুষ না খেয়ে এক দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মতো জীবন যাপন করছে। এখানের মানুষের অসহায়ত্ব আর হাহাকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়তই। নদীর বিষাক্ত লোনা পানি তাদের স্বপ্ন এবং আশাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে।

এখানের মানুষের দুরবস্থা অতীতের সকল কিছুকেই অতিক্রম করেছে। এখানের মানুষ আজ নিঃস্ব, রিক্ত এবং আশাহীন ভাবে দিনাতিপাত করছে। এখানের কোমলমতি শিশুদের পড়াশোনার চেয়ে খিদের জ্বালা মেটানো প্রধান প্রয়োজন। তাদের দুর্দশা এবং হাঁহাকারে প্রতিনিয়তই আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদ যায় আজ কাঠমারচর গ্রামের মানুষকে এক অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। এখানের মানুষের প্রাণের দাবি – টেকসই বেড়িবাঁধ চাই। সরকারের উচ্চ মহল এবং স্থানীয় সরকারের সমন্বয় এখানের

মানুষের সংকটময় পরিস্থিতি থেকে দ্রুতই উত্তরণের পথ হয়ে উঠুক এছাড়া সময়োপযোগী দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক, এই প্রত্যাশায় সকলের।