২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:১৬
শিরোনাম:

৮ বিয়ে, বহু প্রতারণা: কোটিপতি নীলা এবার জেলে

নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সুলতানা পারভীন নীলা। ডাক নাম বৃষ্টি।নিজের ৩৯ বসন্তে বিয়ে করেছেন আটটি। প্রতারণা করেছেন সব স্বামীর সঙ্গেই। লুটে নিয়েছেন তাদের সর্বস্ব। তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা, হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগও রয়েছে।
এ অবস্থায় সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) নীলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার আগে ঢাকার ১৪ নম্বর আদালতে হাজির হয়ে প্রতারণার মামলায় জামিন আবেদন আবেদন করেন তিনি। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মাইনুল হোসেন তাকে জেলে পাঠান। এ মামলার অপর আসামি ও নীলার বড় ভাই শফিকুল আলম বিপ্লবের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত।

এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর নীলার বিরুদ্ধে গ্রেফতার পরোয়ানা জারি করেন আদালত।নীলার সাবেক (৭ নম্বর) স্বামী এম রহমানের দায়ের করা মামলার আইনজীবী ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট ওয়াদুদ শাহীন বাংলানিউজকে এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন।

এ ছাড়া ঢাকার সিআইডি উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেও বাংলানিউজ এসব বিষয়ে নিশ্চিত হয়। এসআই রফিকুল জানান নীলা খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার সুলতানুল আলম বাদলের মেয়ে। তিনি বহু বিবাহে আসক্ত। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ৮ জনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। পক্ষান্তরে তার বিয়ের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

নীলার সপ্তম স্বামী এম রহমান তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার দায়িত্ব পায় ঢাকার সিআইডি। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট মামলার চার আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রদান করেন আদালত।

সিআইডি’র এ এস আই বলেন, নীলা যে বাসার ঠিকানা ব্যবহার করে আসছেন সেটি সঠিক নয়। একেক সময় তিনি একেক পরিচয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে করতেন। নতুন স্বামীর সহায়-সম্পত্তি হাতিয় আরেকজনকে টার্গেট করতেন। একই নিয়মে তিনি বাকি বিয়েগুলো করেছেন।

নীলার সাবেক স্বামীদের ভাষ্য, শারীরিক গঠন ও রূপ-যৌবনকে পুঁজি করে তিনি প্রতারণা করতেন। বিয়ের নামে ধনাঢ্য ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, চাকরিজীবীদের ফাঁদে ফেলে কোটিপতি বনে গেছেন নীলা। যাদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে কথা কাটাকাটি হতো তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন-যৌতুক দাবি সংক্রান্ত একাধিক মামলা করতেন খুলনার আলোচিত এ নারী। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে সম্পর্কের সূত্র ধরে চেক চুরি করে অপর এক নারীর ব্যাংক হিসাব থেকে ১০ লাখ টাকা উত্তোলনের ঘটনায় মামলা হয়।

একাধিক অভিযোগ ও অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, সুলতানা পারভীন নীলা বিয়ের পরপরই তার স্বামীদের কাছ থেকে দেনমোহরের টাকাসহ নানা কৌশলে বাড়ি-গাড়ি হাতিয়ে নিতেন। পরে তালাক নিতেন। এটি মূলত তার ব্যবসা।

কীভাবে সম্পর্ক গড়তেন নীলা
জানা গেছে, সম্পদশালী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী ও প্রবাসী পুরুষদের বিভিন্ন মাধ্যমে টার্গেট করতেন নীলা। পরে তাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। একটা সময় গিয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতেন। এরপর থেকেই মূলত শুরু হতো তার দাবি দাওয়া। এসব দাবির মধ্যে প্রথমেই থাকতো বিয়ে। বিয়ের পর স্বামীর সম্পদ নিজের নামে করে নেওয়া। নগদ অর্থ, জমি, গাড়িও নিতেন নীলা। পরবর্তীতে স্বামীর সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা শুরু করতেন। এটি থেকে তিনি পৌঁছাতেন তালাক পর্যন্ত।

এক অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে প্রথমবার বিয়ে হয় নীলার। তার সে সময়কার স্বামীর নাম শাহাবউদ্দিন সিকদার। তিনি ছিলেন জাপান প্রবাসী, গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের হরিকুমারিয়া গ্রামে। নীলার বয়স ছিল তখন ১৫ বছরেরও কম। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীর ঘর থেকে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার নিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। তার উচ্ছশৃঙ্খল জীবনযাপন ও মালামাল চুরির ঘটনায় শাহাবুদ্দিন শিকদার মাদারীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (যার নং- ৭৩৮, তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯) করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে শাহাবুদ্দিন-নীলার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়।

২০০৫ সালের ৬ মে খুলনা মহানগরীর শেরেবাংলা রোডস্থ এসএম মুনির হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় নীলার। দ্বিতীয় স্বামীর কাছে নিজেকে ‘কুমারী’ জাহির করে বিয়ে বসেন তিনি। কাবিনে দেন মোহর ধরা হয় মাত্র ১ লাখ টাকা। বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই নীলার উচ্ছশৃঙ্খল জীবনযাপন ও উগ্র আচরণের শিকার হন মুনির। এক পর্যায়ে বিয়ের সময় পাওয়া স্বর্ণালঙ্কার ও স্বামীর নগদ কিছু অর্থ নিয়ে ঘর ছাড়েন নীলা। এ ঘটনায় সে বছরের ১০ ডিসেম্বর মুনির হোসেন তাকে তালাক দেন। ২০০৬ সালে মুনিরের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পারিবারিক আদালতে মামলা করেন নীলা। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মুনিরের কাছ থেকে অর্থ আদায়।

দুবছর পর আবারও একই দাবিতে নগরীর খালিশপুর ওয়ারলেস ক্রস রোড এলাকার ঠিকাদার মইনুল আরেফিন বনিকে বিয়ে করেন নীলা। ২০০৮ সালের এপ্রিল হওয়া এ বিয়েতে শর্ত ছিল নীলা তার স্বামীকে অপর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ইতালি নিয়ে যাবেন। এতে তাকে দিতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। বনি টাকা দিলে সেটি নিয়ে অন্তরালে চলে যান নীলা। এ সময় থেকে তার প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন বনি। পরে তাদের তালাক হয়।

এর কয়েক দিন পর নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে করায় নীলার বিরুদ্ধে খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন বনি। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে মামলাটি রুজু হয়েছিল।

বনির মামলা চলমান অবস্থায় ২০১১ সালে নীলা বিয়ে করেন নারায়ণগঞ্জের ইফতিখার নামে একজনকে। তার কাছ থেকেও নগদ অর্থসহ সম্পদ লুট করেন নীলা। পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ইফতেখার আমেরিকায় চলে যান। ২০১২ সালে নীলা বিয়ে করেন বাগেরহাটের বাসিন্দা কামাল হোসেনকে। ২০১৭ সালে ইতালি প্রবাসী মাদারীপুরের মোহাম্মদ আজিম ও ২০১৮ সালে খুলনার এম রহমানকে বিয়ে করেন।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে খুলনা মহানগরীর নাজির ঘাট এলাকায় মো. আব্দুল বাকী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বাকীর কাছ থেকে একটি চেক ও নগদ অর্থকড়ি চুরি করেন নীলা। পরে তাদের ছাড়াছাড়ি হলে বাকী বিষয়টি নিয়ে ঢাকার আদালতে মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে তাকে গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির দাবিতে ২০২১ সালের ২২ মার্চ দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন তিনি।

উল্লেখ্য, নীলার বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি জিডি দায়ের রয়েছে। এতে তার এক স্বামী অভিযোগ করেন, সিরাজগঞ্জে অবস্থানকালীন ঢাকার একটি ফ্ল্যাট নীলার নামে লিখে না দেওয়ায় নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসানো ও জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২ মে জিডিটি দায়ের হয়।