২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৪:৩৯
শিরোনাম:

সিপিবি সমাবেশে বোমা হামলা মামলায় ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড

রাজধানীর পল্টনে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ১০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও দুইজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। আগামী ৭ দিনের মধ্যে আপিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার (২০ জানুয়ারি) বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ  রায় ঘোষণা করেন। ডিবিসি টিভি ও বাংলানিউজ

এ মামলার আসামিরা হলেন— মুফতি মঈন উদ্দিন শেখ, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মো. মশিউর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুত্তাকিন, আমিনুল মুরসালিন, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিরাজ ও নুর ইসলাম। এছাড়া আসামিদের মধ্যে জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় আগেই মামলা থেকে তাকে অব্যহতি দেয়া হয়। বর্তমানে ৪ আসামি কারাগারে। বাকি ৮ জন পলাতক।

২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পল্টনের মহাসমাবেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে পার্টির বেশ কয়েকজন নেতা মারা যান। এ হামলায় খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সিপিবি নেতা হিমাংশু মণ্ডল, রূপসা উপজেলার সিপিবি নেতা ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা আব্দুল মজিদ, ঢাকার ডেমরা থানার লতিফ বাওয়ানি জুট মিলের শ্রমিক নেতা আবুল হাসেম ও মাদারীপুরের মোক্তার হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। এছাড়া বোমা হামলায় খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা বিপ্রদাস রায় আহত হয়ে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মারা যান। এছাড়া আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী। এদের মধ্যে অমর মণ্ডল, লক্ষণ মণ্ডল, মো. জাহাঙ্গীর, আব্দুস সাত্তার, মিজানুর রহমান, এম এ করিমসহ অনেকেই পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন।

২০১৩ সালের নভেম্বরে সিআইডি হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলায় আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। পরের বছরের সেপ্টেম্বরে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১ ডিসেম্বর, রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়। এ মামলার ১০৭ সাক্ষীর মধ্যে ৩৮ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণে সফল হয়েছেন এমন দাবি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি মো. আব্দুল্লাহ আবুর।

পল্টন ময়দানে সিপিবির সেই মহাসমাবেশে উপস্থিত কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের লোমহর্ষক ঘটনা কাছে তুলে ধরেন। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা এস এম চন্দন বলেন, সেদিন বিকেল ৫টার দিকে সিপিবির মহাসমাবেশে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বাদাম খাচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকালে যেমন আলোর ঝলকানি দেখা যায়, দিনের বেলায় তেমননি আলোর ঝলকানি দেখতে পেলাম। এ সময় মনে হলো পল্টন ময়দানটাকে কে যেন একটা ঝাঁকি দিলো। এতে আমি কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়েছিলাম। আমি প্রথমে ভেবে ছিলাম কেউ হয়তো পটকা ফুটিয়েছে। একটু পরেই মনে হল পটকার শব্দ কি করে এতো তীব্র হবে, মাটি কেঁপে উঠবে, আগুনের উল্কা দেখা যাবে? এরপর একটু এগুতেই দু’জনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি। এ মধ্যে একজন হিমাংশু মণ্ডল তিনি আমার পরিচিত ছিল। এরপর মরদেহ নিয়ে মিছিল হয়। স্টেডিয়ামের ভাসানী গেটের দিকে মিছিল গেলে পুলিশ মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর আমি রাজশাহী চলে আসি। পরদিন ২১ জানুয়ারি অর্ধবেলা দেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়।

তিনি বলেন, সেদিন আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল, আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম। স্টেডিয়াম মার্কেটের ভেতরে সিঁড়ির কাছে একই সময়ে আরও একটা বোমার বিস্ফোরণে দু’জন হকার মারা যান। এ বিষয়টি এখনো পরিষ্কার হয়নি, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িতরাই কি স্টেডিয়ামের ভেতরের এ হামলা করেছেন, সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার সঙ্গে এ ঘটনার কোনো যোগসূত্র রয়েছে কিনা? না অন্য কেউ এ হামলা করেছে? তবে সেদিন বোমা হামলায় সিপিবির পাঁচজন এবং দু’জন হকারসহ মোট সাতজন নিহত হয়েছিলেন।

বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সিপিবি সদস্য মুর্শিকুল ইসলাম শিমুল সেদিনের বোমা হামলা প্রসঙ্গে বলেন, সমাবেশ চলাকালে মোর্শেদ আলীর (তৎকালীন সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষক সমিতির সভাপতি) বক্তব্য দেওয়ার সময় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এর কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন মোটর শ্রমিক তৎকালীন সিপিবি সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান সম্পর্কে বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য সম্বলিত কিছু লিফলেট বিতরণ করছিল। তখন আমি এবং তৎকালীন খুলনা ছাত্র ইউনিয়নের রাসেল নামে একজন লিফলেট বিতরণকারীদের আটক করি। বোমা যেখানে বিস্ফোরণ ঘটে তার থেকে একটু দূরেই আমি ছিলাম। বিস্ফোরণের সময় আমি মাটিতে পড়ে যাই, বোমার আঘাতে আমার কানের পর্দা ফেটে যায়। মাটি থেকে উঠেই দেখি চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। এরপর দেখি কয়েকটি মরদেহ পড়ে আছে।

বর্তমান সিপিবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সেদিনের বোমা হামলা প্রসঙ্গে শাহাদত হোসেন বলেন, বোমা হামলা যেখানে হয় আমি সেখান থেকে সামান্য দূরে মাঠে ছিলাম। সমাবেশে তখন বক্তব্য চলছিল। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর চারিদিকে মানুষের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। সমাবেশস্থলের আশপাশে কয়েকটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি। আহতদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়।

বর্তমানে সিপিবির সম্পাদক এবং তৎকালীন সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বোমা হামলার প্রসঙ্গে বলেন, সেদিন সিপিবির সমাবেশের বিশেষত্ব ছিল সমাবেশে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুরসহ সমাজের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও সমস্ত বামপন্থি দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান ইমামসহ আরও অনেকে। আমার বিবেচনায় সেদিন সিপিবির লাখো মানুষের সমাবেশ দেশে বামপন্থিদের উত্থানের একটা বার্তা দেখা যাচ্ছিলো। আমার ধারণা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বামপন্থিদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য বোমা হামলা চালায় যেন বামপন্থিদের উত্থান না ঘটতে না পারে।

তিনি বলেন, আমরা মঞ্চে ছিলাম। মঞ্চ থেকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি যে এমন একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা তখনো মঞ্চ থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে সমাবেশের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেই। কিছুক্ষণ পর দেখি রক্ত আর রক্ত। আমাদের চারজন নেতা সেখানেই মারা যান। এরপর সমাবেশের চারিদিকে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। আহতদের কীভাবে হাসপাতালে পাঠানো যায় সেই ব্যবস্থা করা হয়। এ ঘটনায় আমাদের খুলনার সিপিপির হিমাংশু মণ্ডল বোমার আঘাতে মৃত্যুবরণ করলেও শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রতীক লাল পতাকা হাতে উঁচু করে ধরে রেখেছিলেন।