৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ভোর ৫:১৫
শিরোনাম:

মাদ্রিদের ডায়রি: ‘ঐতিহ্যবাহী’ নাচে ‘জীবনের গল্প’ ফ্ল্যামেনকো

করোনায় আক্রান্ত বিশ্ব। কভিড ১৯ ভাইরাসে বিশ্ব আজ কার্যত স্তব্দ। সবচে’ বেশি আক্রান্ত শহরগুলোর একটি স্পেনের মাদ্রিদ। কিছু সময় আগে এক বন্ধু আমাদের পরিচিত এক বড়ো ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ জানালো। খুব মন খারাপ করে আমিও বন্দী হয়ে আছি ঢাকায়। আটতলার উপরে বেড রুম, ড্রয়িংরুম আর ডাইনিংয়ের বাইরে কোন পদচারনা নেই। মন খারাপের মধ্যেই মনে পড়ছে গত ডিসেম্বরে মাদ্রিদ ভ্রমণের নানা স্মৃতি। আমি যে মাদ্রিদ দেখে এসেছিলাম, করোনা পরবর্তী মাদ্রিদ দেখতে কেমন হবে। সেই সব চেনামুখগুলো কী আবার দেখতে পাবো- এসব নানা ভাবনা মাথায় আসে। এসবের মধ্যে মাদ্রিদ ভ্রমণে সবচে’ আনন্দময় স্মৃতিটুকু শেয়ার করার জন্যই বাসার ওয়ার্কস্টেশনে বসলাম।

আজ জানাবো এক ঐতিহ্যবাহী নাচের ইতিকথা…

আবেগময় সঙ্গীত, বলিষ্ঠ গায়কী আর আকর্ষণীয় নাচে জীবনের এক একটি গল্প বলে যায় এক একটি নাচ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে নাচ দেখা, হাত তালি দিয়ে অংশ নেয়া কিংবা আবেগে অশ্রু বয়ে পড়ে প্রতিমুহুর্তে। স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ফ্ল্যামেনকো ড্যান্সে আবারও মুগ্ধ হলাম মাদ্রিদের পুরোনো এক ড্যান্সবারে।

২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৫) দিনের কাজ সেরে গিয়েছিলাম মাদ্রিদের মূল স্কোয়ার ‘প্লাজা মায়োরে’। মাদ্রিদে আসা পযর্যটকদের আকর্ষণের মূল জায়গা এই প্লাজা মায়োর। এখানে আশেপাশে প্রচুর দোকানপাট, খাওয়া-দাওয়ার হোটেল, অস্থায়ী দোকাপাট এমনকি ভাসমান হকারে পরিপূর্ণ থাকে সব সময়। এ কারনে পর্যটকদের ভীর লেগেই থাকে সবসময়। আমাদের গুলিস্তানের মতো লোক সমাগমের মধ্যে রয়েছে অনেক ‘পকেটমার’। এ কারনে এখানে আসার আগেই সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হয়। প্লাজা মায়োরে অনেক বাংলাদেশী হকার ও দোকানদারের দেখা মেললো। কেউ পাওয়ার ব্যাংক, সেলফি স্টিক অথবা রাবার বা প্লাস্টিকের নানা খেলনা বিক্রি করছে।

এখান থেকে সিড়ি বেয়ে একটু নিচে নেমে পায়ে হাটা পথে দু’মিনিটের দূরত্বে ‘লা তাবেরেনা দ্যা মিস্টার পিঙ্কলেটন’। এটি মাদ্রিদের খুবই বিখ্যাত একটি ফ্ল্যামেনকো বার। যেখানে যেতে আগে থেকেই বুকিং দিতে হয়। ২/৩ দিনের বুকিং থাকে সবসময়ই। মাদ্রিদ আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক রিজভী আলম আগে থেকেই এর বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। সাধারণত: দু’ধরনের বুকিং দেয়া যায় এখানে। নাচ দেখা এবং সঙ্গে পানীয় ৩০ ইউরো বা প্রায় ২ হাজার ৮শ’ ৫০ টাকা আরেকটি নাচ দেখা, পানীয় এবং রাতের ডিনারসহ ৬০ ইউরো বা পাঁচ হাজার ৭শ’ টাকা। এতোগুলো টাকা খরচ করে নাচ দেখবো বলে মন খারাপ ছিল। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী নাচ হওয়ায় ভেতরে তীব্র আকর্ষণও অনুভব করছিলাম। রাত আটটার দিকে ডুকে পড়লাম ‘এ ম্যাজিক্যাল নাইট মাদ্রিদ ফ্ল্যামেনকো’ দেখতে।

বুকিং থাকার কারনে আমাদের আসন আগে থেকেই নির্ধারিত। দ্বিতীয় সারিতে পড়েছে আমাদের আসন। এখানে বসার ব্যবস্থা অনেকটা ঘরোয়া। আগে থেকেই টেবিলে সাজানো ছিল পপকর্ণ, চিপস ও ড্রিঙ্কস। খেতে খেতে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সামনের স্টেজটি দেখছিলাম। স্টেজটির উপর কাঠের শক্ত পাটাতন। ফ্ল্যামেনকো ড্যান্সের এটাই মূল অংশ। বাহারী রঙে সাজানো স্টেজটি। মূল প্ল্যাটফর্মটিও রঙ করা ছিল কিন্তু নৃত্যশিল্পীদের নাচের মুদ্রার শক্ত আঘাতে কোথাও কোথাও রঙচটে গেছে। পপকর্ণ, চিপস আর পানীয় পানের মধ্যেই চলে এলেন শিল্পীরা। একে একে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো সবাইকে। একজনে গান ধরলেন, একজন ড্রাম বাজালেন, একজন গিটার, একজন বাশি, একজন মুখে হাত দিয়ে শব্দ করছেন আর একজন হাততালি দিয়ে গান ধরলেন। এরই মধ্যে চলে এলো বাহারী পোষাকের একজন নারী নৃত্যশিল্পী। একটু পরে যোগ দিলেন আরো একজন পুরুষ নৃত্যশিল্পী। তার পোষাকেও বিশষত্ব রয়েছে। কিন্তু নারী ও পুরুষ উভয় শিল্পীর পায়ের জুতো একই রকমের। এটাই নাচের বিশেষত্ব। নাচের বিশেষ মুদ্রার সঙ্গে শারীরিক শৈলী প্রদর্শন ও শক্ত পাটাতনে মুদ্রার সশব্দ আঘাত এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। জুতোর হিলের অংশটি শক্ত হওয়ায় কাঠের উপর আঘাতে আরো বেশি শব্দ হয়। ফ্লামেনকো নাচকে বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে ফ্লামেনকো শিল্পীদের পোষাক। নানা বর্ণের আকর্ষণীয় ও দীর্ঘ হয়ে থাকে পোষাক। নাচের তালে তালে পোষাকের প্রদর্শনও এই নাচের একটি বড়ো বৈশিষ্ট। পোষাক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পটু না হলে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নৃত্যশিল্পীদের যা কখনো হয়না।

ফ্ল্যামেনকো মূলত: স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকা আন্দালুসিয়ার একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নৃত্য কৌশল যাতে রোমানিয়ানদের প্রভাব রয়েছে। তবে এর উৎপত্তি নিয়ে এখনও বিতর্কের শেষ হয়নি। স্প্যানিশ ভাষার অভিধানে প্রাথমিকভাবে একে স্প্যানিয় ও রোমানি ভাষার সৃষ্ট শৈলী হিসেবে বিবেচনা করে। উইকিপিডিয়া বলছে, উৎপত্তি সম্পর্কিত অনুমানগুলির মধ্যে সর্বাধিক বিস্তৃত ধারণার অনুযায়ী ফ্লামেনকো আন্দালুসিয়ার স্থানীয় আন্দালুসিয়, রোমানি, ক্যাসিলিয়, মুর এবং সেফার্ডি ইহুদিদের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময় মাধ্যমে বিকশিত হয়েছিল বলে বিবেচিত হয়। বিংশ শতকের প্রথম দিকে কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা লিখেছিলেন যে, আন্দালুসিয়ায় ফ্ল্যামেনকো উপস্থিতি এই অঞ্চলে রোমানি জনগণের আগমনের পূর্বাভাস দেয়। এ নিয়ে বিতর্ক যা-ই থাক এটি একটি ছন্দময় আকর্ষণীয় নৃত্যকলা ও ঐতিহ্যের অংশ। কালক্রমে ফ্ল্যামেনকো সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং অনেক অ-হিস্পানিক দেশ, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে এটি শেখানো হয়। স্পেনের পর জাপানে সর্বাধিক ফ্ল্যামেনকো একাডেমি রয়েছে। ২০১০ সালের ১৬ নভেম্বর, ইউনেস্কো কর্তৃক ফ্লামেনকো নৃত্যকে মানবতার মৌখিক ও অনুভূতিহীন ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ঘোষণা করা হয়।

ফ্লামেনকোর এক একটি নাচে থাকে এক একটি গল্প। সবগুলোই জীবনের গল্প। কিংবা এ গানের উৎপত্তিস্থলের গল্প। বা সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটের গল্প। এমন সব গল্পে ফ্লামেনকো শিল্পীরা নাচে হয়তো নিজেও জানেনা এ গানের উৎপত্তির ইতিহাস। এমনই এক গল্প ছিল এক নাবিকের সঙ্গে বন্দর এলাকার এক নারীর প্রেম, প্রণয় এবং তাদের ভালোবাসার সন্তানকে নিয়ে। জাহাজের নাবিক বন্দরে নেমে একটি পানশালায় পরিচিত হয়েছিল এক তরুণীর সঙ্গে। সেখান থেকে তাদের প্রেম ও পরিণয়ের পর অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়ে তরুণীটি। এরই মধ্যে তার জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে যায়। এক সময়ে জাহাজ ছেড়ে যায়। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে তরুণীটি। প্রতিদিনই পথ চেয়ে থাকে। বন্দরের কাছে গিয়ে জাহাজ দেখে আর অপেক্ষা করে তার নাবিকের জন্য।

এমন বেশ কয়েকটি গল্প আর গানে শেষ হয় সেদিনের পর্ব। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে আমার মাঝে। নিজ উদ্যোগেই গিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হই। স্প্যানিশ ভাষায় গান হওয়ায় অনেক গল্প না বোঝায় ইংরেজীতে বোঝার চেষ্টা করি। বেশ আগ্রহ নিয়ে গল্পগুলো বলে আমাকে। শেষে সবার সঙ্গে একটি গ্রুপ ছবি তুলতে চাইলে আপত্তি করলো না। এরই মাঝে তাদের এক শিল্পীর জন্মদিন উদযাপন করা হয় ছোট্ট একটা কেক কেটে। খুব ছোট্ট সেই কেকটি একজনের জন্যই যথেষ্ঠ। আমরা এর ভাগ না পেলেও জন্মদিনের শুভ কামনা জানাতে কার্পন্য করিনি।

আগেও ফ্লামেনকো নাচ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ২০১৬ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক লোক সঙ্গীত উৎসবে প্রথম ফ্লামেনকো দেখি। সে সময়ে শিল্পী কারেন লোগো ও রিকার্ডো মোরো এসেছিলেন তাদের দল নিয়ে। স্পেনে যাওয়ার কিছুদিন আগে আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে দেখেছিলাম স্পেনের নাট্যদল ‘মুন প্যালেস’ এর পরিবেশনায় ‘ডিলেমাস উইথ মাই ফ্লামেনকো টেইলকোট’। এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক। একজন নৃত্যশিল্পী নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এই পরিবেশনার মূল উপজীব্য। গল্পটি ইসাবেল ভালদেরামার যিনি ‘সোনালী নক্ষত্র’ নামে পরিচিত। তার জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এ নাটক। তার অভিজ্ঞতা এবং নৃত্য ও তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ গল্প নিয়ে তৈরি এ নাটকে ফ্ল্যামেনকো নাচ নিয়ে কী করে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে তা বলা হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতার চেয়ে এতো বিস্তৃত পরিসরে ফ্ল্যামেনকো দেখার অভিজ্ঞতা মাদ্রিদেই হলো।

স্পেনের কোথাও কোথাও ফ্ল্যামেনকোর মাধ্যমে প্রতিবাদের ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ২০১৪ সালে ফ্ল্যামেনকোর জন্মভূমি আন্দালুসিয়ার সংসদে গানের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর একটি ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। কয়েক বছর ধরে স্পেন ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের সাথে সংগ্রাম করার কারণে রাষ্ট্রীয় ব্যয় ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা হয়। সারা দেশ জুড়ে দরিদ্র এবং বেকার লোকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। আন্দালুসিয়াতে যার প্রভাব পড়ে প্রবলভাবে। প্রতিবাদকারীরা ফ্লামেনকো রীতিতে বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে কথা বলেছেন। প্রতিবাদকারীরা সংসদের দর্শক গ্যালারিতে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তাদেরকে সে সময়ে গ্যালারি থেকে বের করে দেয়া হয়। পরে এর ভিডিও ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়।

ফ্ল্যামেনকো শো দেখার এই ঘটনা আমার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে থাকবে। মাদ্রিদে আমার সপ্তাখানেক অবস্থানের সময়েও ফ্ল্যামেনকো নাচ দেখেছি বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে, জনবহুল এলাকায়। বিশেষ করে মাদ্রিদের জিরো পয়েন্ট, লাভাপিয়েসের পথে পথে ৪/৫ জন ফ্ল্যামেনকো শিল্পী মিলে একটি কাঠের ছোট্ট পাটাতনের উপর ফ্ল্যামেনকো প্রদর্শন করে। প্রদর্শন শেষে উপস্থিত দর্শকদের সামনে মাথার ক্যাপ খুলে ধরে। তাতে কেউ দু’চার ইউরো দেয়। এটাই তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। এসব পথ শিল্পীদের পরিবেশনা কম মনোমুগ্ধকর নয়। নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী নাচকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এর মাধ্যমে নিজেদের বেঁচে থাকার এই মেলবন্ধনই যুগ থেকে যুগান্তরে নিয়ে যাবে ফ্ল্যামেনকো’কে।