১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ৯:১৮
শিরোনাম:

ইয়াবা মামলায় গ্রেপ্তার করায় হয়রানির শিকার পুলিশকর্তা

২০১৮ সালে ভোলার সবচেয়ে দক্ষিণের থানা আইচায় একটি মামলা হয় ইয়াবা সংক্রান্ত। মামলায় ওই থানার উত্তর চরকলমি এলাকার আবদুল জলিল ফরাজী ওরফে মতুর ছেলে মো. আশরাফুল আলম দিপুকে আসামি করা হয়। আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলে পুলিশ; বিচারকের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে আসেন ২০ বছর বয়সী এ তরুণ।

আইচা থানার পরিদর্শকসহ ৮ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইজিপির অভিযোগ সেলে অভিযোগ দায়ের করেন। সেটি আমলে নিয়ে চলছে পুলিশ সদর দপ্তরের তরফে তদন্ত আর এর জের টানতে হচ্ছে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, তাদের রিমান্ডে থাকাকালে দিপু স্বীকার করেছে, ভুয়া অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হয়রানি করার বিষয়টি।

সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রতারণার মাধ্যমে রীতিমতো বোকা বানিয়ে দিপু হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, এই রয়েল চিটার দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করতেন সরকারি প্রটোকল নিয়ে। নিজেকে কখনো নোমান গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান, কখনো মার্কিন নাগরিক, কখনো এনএসআই’র পরিচালক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন দিপু।

এমনকি প্রয়োজন হলে নিজেকে তিনি জাহির করতেন পুলিশের বা দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবেও। এক কথায়, প্রতারণার জন্য যেখানে যখন যেমন পরিচয় প্রয়োজন হতো, সেখানে তেমন পরিচয়েই নিজেকে তুলে ধরতেন দিপু। এভাবে তিনি বিচারক, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও বোকা বানিয়েছেন।

তদন্ত সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে দিপু জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ কাউকে প্রভাবিত করে একবার বোকা বানাতে পারলে এমনিতেই বাকি কাজ বাগিয়ে নিতে পারতেন তাকে দিয়ে অন্য সব প্রভাবশালীদের কব্জা করার মাধ্যমে।

১৪ বছর বয়সে ভোলায় ত্রাণের টাকা আত্মসাতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিপুর প্রতারণা। তার রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি। চড়তেন নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে। সকালের নাস্তা করতেন পাঁচতারকা হোটেলে। স্কুলের গ-ি না পেরোলেও দিপু দাবি করতেন স্নাতক পাস।

সর্বশেষ গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক পরিচয়ে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৩১ জানুয়ারি সকালে রাজধানীর পল্লবী থানা এলাকা থেকে দিপুকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এ সময় তার কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, সিমকার্ড, চাকরি হয়েছে সংবলিত সরকারি গেজেটের প্রিন্টেড কপিসহ অন্যান্য আলামত জব্দ করা হয়।

এ বিষয়ে দিপুর বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলা করেন লেকশো অটো লিমিটেডের গাড়িচালক মীর সুজেল। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে তিন দিনের পুলিশি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে দিপুকে। গতকাল শুক্রবার ছিল রিমান্ডের শেষ দিন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দিপুর বিরুদ্ধে মামলার খবর পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ৪টি মামলার নথি এসেছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে। এসব মামলায় তাকে পুনরায় রিমান্ডে নেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ভুয়া প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে অহরহই প্রটোকল নিতেন দিপু। নিতেন পুলিশি প্রটোকলও। স্পর্শকাতর সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরও তিনি বোকা বানিয়ে ছেড়েছেন বলে প্রমাণ মিলেছে তদন্তকালে।

সূত্র জানায়, এনএসআই’র সহকারী পরিচালক পদে ভুয়া নিয়োগপত্র পাঠিয়ে একজনের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন দিপু। ‘একমাত্র রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহার’যুক্ত খামে করে ডাকযোগে ভুয়া নিয়োগপত্রও পাঠাতেন দিপু।

এ বিষয়ে ডিবির ওয়েব-বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি আশরাফ উল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, তিন দিনের রিমান্ডে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে দিপু। এসব যাচাই-বাছাই হচ্ছে।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় সব উচ্চ পর্যায়ের দপ্তরের নামে ভুয়া প্রজ্ঞাপন বানিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। স্কুলে নিয়োগ, এনএসআইতে চাকরি দেওয়া, করোনাকালে মানুষকে সহযোগিতার কথা বলে ‘মানবিক টিম’ নামে ফেসবুক পেজ খুলে প্রবাসীদের পাঠানো লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন প্রলোভনে যাকে যেভাবে বশে আনা সম্ভব সেটাই করতেন দিপু। সাধারণ মানুষ তো বটেই। প্রতারণার জন্য দিপু ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। ইউটিউব দেখে প্রতারণার কৌশল আয়ত্ত করে তৈরি করেন ইউটিউব চ্যানেলও।

তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পুলিশের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো দেখে যে কেউই মনে করতেন তিনি প্রশাসনের কোনো বড় কর্তা। ভোলা, কিশোরগঞ্জ, সিলেটে সরকারি প্রটোকলে এভাবেই সফর করেছেন দিপু। এমনকি সৌদি সরকারের ডাকে হজও করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে ভুয়া প্রজ্ঞাপনে তিনি নিজেকে তুলে ধরেছেন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার নিরাপত্তা গোয়েন্দা। আর পদায়ন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।