৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৪:৫৩
শিরোনাম:

বাণিজ্যমেলা উপলক্ষে ছাড়া হচ্ছিল কোটি টাকার জাল নোট

টেবিলের ওপর বসানো কম্পিউটার। তাতে যুক্ত প্রিন্টার। মাউসে চাপ দিলেই বেরিয়ে আসছে হাজার ও ৫০০ টাকার চকচকে নোট। তবে এসব টাকা আসল নয়, সবই জাল।

বাণিজ্যমেলা উপলক্ষে কোটি টাকার বেশি জাল নোট বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি চলছিল ঢাকার মিরপুরে পল্লবীর একটি বাড়িতে। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এমন জাল টাকা তৈরি করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতেন ছগির হোসেন ও তার দলের সদস্যরা।

কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তাপর্যায়ে এসব জাল নোট ছড়িয়ে দিতে দেশজুড়ে ছিল ডিলার। পুরো এক লাখ টাকার জাল নোট তৈরিতে খরচ হতো মাত্র চার হাজার টাকা। এর মধ্যে এক হাজার নোটের এক লাখ টাকার বান্ডিল ১৫ হাজারে বিক্রি হতো। আর ৫০০ টাকার নোটের এক লাখের বান্ডিল বিক্রি হতো ১০ হাজার টাকায়।

সোমবার (৩ জানুয়ারি) রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের মূলহোতা ছগির হোসেনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে এলিট ফোর্স র‌্যার। এসময় এক কোটি ২০ লাখ টাকা সমমানের জাল নোট, পাঁচটি মোবাইল, দুইটি ল্যাপটপ, একটি সিপিইউ, তিনটি প্রিন্টারসহ জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানিয়েছেন, তারা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ঢাকা ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট বিক্রি করে আসছিলেন। চক্রটির মূলহোতা ছগির। আর বাকিরা তার সহযোগী। চক্রের সঙ্গে ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত।

জাল টাকা কারবারে গ্রেফতার ছগির হোসেন ১৯৮৭ সালে বরগুনা থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে একটি হোটেলে বয়ের কাজ নেন। পরবর্তীতে ভ্যানে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন গার্মেন্টস পণ্য। এসময় ছগিরের সঙ্গে ইদ্রিস নামে এক জাল টাকা কারবারির পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ও জাল নোট তৈরির হাতেখড়ি।

ছগির প্রথমে জাল নোট বিক্রি করতেন। পরে রপ্ত করেন নোট তৈরি। ২০১৭ সালে জাল নোটসহ ইদ্রিস ও ছগির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বছরখানেক জেল খেটে বেরিয়ে এসে পুনরায় ২০১৮ সাল থেকে শুরু করেন জাল নোট তৈরি। এসব নোট তার চক্রে থাকা রুহুল আমিন, সেলিনাসহ ৭-৮ জনের মাধ্যমে বিক্রি করতেন।

পুরান ঢাকা থেকে জাল টাকার উপকরণ কেনেন ছগির

ছগির নিজেই পুরান ঢাকা থেকে জাল টাকা তৈরির উপকরণ টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি ক্রয় করেন। এরপর তার ভাড়া বাসায় গোপনে বিশেষ কৌশলে এ-৪ সাইজের দুইটি টিস্যু পেপার এক করে আঠা লাগিয়ে রঙিন প্রিন্টারে টাকা তৈরি করতেন। তিনি নিজেই করতেন প্রিন্টিং। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রিন্টিংয়ের কাজে অন্যান্যদের সম্পৃক্ত করা হতো না। জাল টাকা তৈরির পর সহযোগীদের মোবাইলে কল করে তার কাছ থেকে নোট নিয়ে যেতে বলতেন।

১৫ হাজারে লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি

প্রতি এক লাখ টাকার জাল নোট তৈরিতে ছগিরের খরচ হতো ৪-৫ হাজার টাকার মতো। আর লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করতেন ১০-১৫ হাজার টাকায়। তার সহযোগীরা মাঠ পর্যায়ে এ টাকা সরবরাহ ও বিক্রি করতেন। টার্গেট বা চাহিদা অনুযায়ী ছগির প্রতিমাসে তাদের দিতেন বোনাসও।

যেখানে ছিল টার্গেট

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ছগির জানিয়েছেন, করোনাকালীন মাঝে মাঝে ছগির নিজেও এ জাল টাকা স্থানীয় বাজারে ব্যবহার করেছেন। কয়েকবার তিনি জনগণের হাতে পড়েছিলেন ধরাও। সাধারণত কোনো মেলা, ঈদে পশুর হাট ও অধিক জনসমাগম অনুষ্ঠানে তারা জাল নোট ব্যবহার করেন। সম্প্রতি পূর্বাচলে আয়োজিত বাণিজ্যমেলা ও শীতকালীন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন উৎসব এবং মেলাকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা তৈরির পরিকল্পনা করেন ছগির। এ লক্ষ্যে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি তৈরি করে আসছিলেন জাল টাকা।

ধরা পড়ার আশঙ্কায় অব্যবহৃত অংশ পুড়িয়ে ফেলা হতো

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে গ্রেফতার ছগির জাল নোট প্রিন্টিংয়ের সময় কাগজের অব্যবহৃত ও নষ্ট অংশগুলো পুড়িয়ে ফেলতেন। এছাড়া তিনি যেনো ধরা না পড়েন সে জন্য ঘন ঘন বাসা করতেন পরিবর্তন।

অপরদিকে গ্রেফতার সেলিনা আক্তার ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতেন। স্বামীর মাধ্যমে ছগিরের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর তিনি নিজেও এ চক্রে জড়িয়ে জাল নোট ব্যবসা শুরু করেন।

ছগিরের আরকে সহযোগী রুহুল আমিন বিভিন্ন সময় ৫০০ টাকার জাল নোট হাসপাতাল ও মেডিকেলসহ ব্যস্ত এলাকায় বিক্রি ও এক্সচেঞ্জ করেন। জাল নোট তৈরি ও বিক্রির মামলায় ইতোপূর্বে ২০১৭ সালে জেলে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তার নামে মামলা রয়েছে।