১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৫:১৫
শিরোনাম:

সুভাষদাশগুপ্ত  : বাংলাদেশে গম আমদানিতে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

২০০৮-০৯সালে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে যে চরম সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠার ঠিক দেড় দশকের মাথায় আবারও এক সংকটের মধ্যে পড়েছে গোটা বিশ্ব। সেবার ছিল চাল, আর এবার গম। তাই এই সংকটের মোকাবিলা করতে হবে ধনী-  দরিদ্র সব দেশকেই। এই সংকটের মূল কারণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে সামরিক সংঘাত। ধারনা করা হচ্ছে এই দুই দেশের সংঘাত আগের চেয়ে আরও ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী  হবার সম্ভাবনা  অনেক বেশী।

অবস্হার দ্রুত উন্নতি হলেও(যার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ) আগামী জুন মাসে এই দুই দেশে গম হারভেস্ট করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে কিনা, এনিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যদি না হয় তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের প্রাপ্যতাজনিত সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত হবে।স্বাভাবিকভাবে,   এর থেকে উত্তরণের পথে দরিদ্র দেশগুলিকে উন্নত দেশগুলির চেয়ে অনেক কঠিন সমস্যার সম্মূখীন হতে হবে। এই সংকট,  বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা  (Food & Nutrition security)  ও খাদ্য ব্যবস্হার(Food system) ওপর  প্রভাব পড়তে পারে।

এই যুদ্ধের কারণে যেসব খাদ্য উপাদানের প্রাপ্যতা সংকট প্রকট হতে পারে, তাদের অন্যতম হল গম।গম আমাদের দানা জাতীয় খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।আমাদের দেশে মাথা পিছু দৈনিক গমের ব্যবহার ৪৫ গ্রামেরও বেশী।খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।দেশে এখন অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে অধিক পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্যের ব্যবহারের ওপর। এক্ষেত্রে, গম একটা অত্যন্ত উপযোগী খাদ্য। চালে যেখানে ৬-৭ শতাংশ প্রোটিন থাকে সেখানে গমে থাকে ১২ শতাংশেরও অধিক, চালের থেকে প্রায় দ্বিগুণ।

এছাড়াও,  আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে বছরে ৪৮-৫০ মিলিয়ন টন চাল বিক্রি হয় সেখানে গম বিক্রি হয় ১২০-১২৫ মিলিয়ন টন। সুতরাং গমের প্রাপ্যতা আন্তর্জাতিক বাজারে চালের থেকে বেশী। দামের দিকেও চালের চেয়ে গম সস্তা। সুতরাং, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধিতে গম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। এর প্রতিফলন দেখা যায়, এর ব্যবহারের বৃদ্ধির   হার থেকে। ধারনা করা হয়েছিল, ২০২০ সালে গম আমদানির সর্বোচ্চ পরিমাণ হতে পারে ৪ মিলিয়ন টন, সেখানে বর্তমান গম আমদানি হয় প্রায় ৭ মিলিয়ন টন এবং ২০৩০ সালে আমদানি ১০ মিলিয়ন টনে পৌঁছাতে পারে। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে গম উৎপাদন হয়েছিল ১ লক্ষ ১৩ হাজার টন এবং হেক্টর প্রতি ফলন ছিল মাত্র ০.৮৯ টন। গমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রথম পন্চ-বার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৭৩-১৯৭৮) আওতায় এক ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেয়।

১৯৭৫-এর মর্মান্তিক ঘটনার পরর্বতী সরকারগুলির কর্মসূচীতে গম উৎপাদন বৃদ্ধি অগ্রাধিকার পায়নি। দীর্ঘ ২১ বছর পর, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর, গমের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষভাবে নজর দেয়া হয়। এর ফলশ্রুতিতে, ১৯৯৮- ৯৯ সালে দেশে গমের উৎপাদন হয় ১৯ লক্ষ ৮০ হাজার টন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন, ২০০৫-০৬ সালে গমের উৎপাদন নেমে আসে ৭ লক্ষ ৩৫ হাজার টনে।

অপরদিকে চাহিদা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার  ক্ষমতায় আসার পর, গমের মোট উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেয়। এর ফলে, ২০১৪-১৫ সালে দেশে গমের উৎপাদন হয় ১৩ লক্ষ ৪৮ হাজার টন, যা ২০০৫-০৬ সালের প্রায় দ্বিগুণ। দেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা বৃদ্ধিতে গমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ গম ও ভূট্টা গবেষণা ইনষ্টিটিউট। বাংলাদেশে গমের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

২০২০-২১ সালে মোট গমের উৎপাদন  হয়েছে ১২ লক্ষ ৩০ হাজার টন এবং হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিল ৩.০৬ টন, যা   অনেক প্রধান গম উৎপাদনকারী দেশের চেয়ে বেশী। দেশে গমের বাৎসরিক চাহিদা প্রায় ৮০ লক্ষ টন এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় চাহিদা আভ্যান্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি দ্বারা মেটানো যাবেনা। জাতীয় পর্যায়ে অতি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প প্নণয়ন ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলেও দেশে গমের উৎপাদন ২০লক্ষ টনের বেশী হবার সম্ভাবনা নাই বললে বাডিয়ে বলা হবেনা।

বাংলাদেশ তার চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ গম প্রতি বছর আমদানি করে। আমদানি করা হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। আমদানির পরিমাণ প্রতিবছর বিশ্বে যে গম উৎপাদিত হয় তার ১ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বছরে যত গম বিক্রয় হয় তার প্রায় ৬ শতাংশ। এবছর থেকে আমদানিতে বিরাট  সমস্যা  দেখা দিয়েছে। এ  অবস্হার কখন শেষ হবে তা ধারণা করাও কঠিন। গমের ব্যবহার খাদ্য হিসেবে বৃদ্ধি পাওয়া এই ইঙ্গিত দেয় যে দেশের মানুষের জীবন-যাত্রার মানের উন্নতি হচ্ছে এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে চালের ব্যবহারও কমতে থাকবে, যদিও খুব ধীর গতিতে।

এই ধারা যাতে অব্যাহত থাকে, তার জন্য গম আমদানির অন্য উৎস খুঁজতে হবে খুব জরুরীভিত্তিতে। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধের কারণে, আমদানির সরবরাহ চেইন যে কোন সময় বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে, যার আগাম অনুমান সম্ভব নাও হতে পারে। এই ব্যাপারে ও খুব সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক: প্রাক্তন সিনিয়র টেকনিকাল অফিসার, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা