৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৮:৩৬
শিরোনাম:

চাঁদাবাজির নয়ামিশন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের,  কারাগারে থাকা আরমান ও রাজিবের বিশেষ তৎপরতা

বিশেষ প্রতিনিধি : চাঁদাবাজির নয়া ছক আঁকছে পলাতাক ও কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। রাজধানীর এলাকাভেদে এ সকল সন্ত্রাসীদের সহযোগীরা ঈদের কোরবানীর হাটে তৎপরতা চালিয়েছে বলে জানতে পেরেছে গোয়েন্দারা। অনেক ব্যবসায়ীই ঝুঁকির কারণে কারও নিকট কোন অভিযোগ দায়ের করেননি। বিষয়টি নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে।

গাজিপুরের কাশিমপুর কারাগারে প্রায় ৬০ জনের অধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। কারাগারে বসে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সহযোগীদের দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী। সম্প্রতি শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান ও রাজিব কাশিমপুর কারাগারে থেকে বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দাবির পাশাপাশি সেখানকার অন্যবন্দিদের স্বজনের নিকটও চাঁদাদাবি করেছে এমন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি নাজমুল মাকসুদ মুরাদের বোন জারা আহমেদের কাছে ফোন করে নানা ধরনের হুমকি দিয়েছেন। আরমানের হুমকির শিকার বন্দিরা হলেন- সৈকত ভবনের মোকসেদ আলী, আতাউর, তিতাসের জুয়েল, বশির উদ্দিনসহ আরো কজন। এসব বিষয়ে জেলারের নিকট অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কারা কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে এরা বন্দিদের নির্যাতন করছে। এতে কারাগারের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। বন্দিদের খাবার সরবরাহ, ভাল থাকার ব্যবস্থাসহ নানা অযুহাতে টাকা নিচ্ছে আারমান ও রাজিব। এ বিষয়ে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের জেলার শাহজাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পাওয়া যায়নি। এদিকে রাজধানীর মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনায় খুন হন। অনেকের নিকটই টিপুর বিষয়টি উল্লেখ করে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। অনেকাংশেই তারা সফল হয়েছে। পুরো চক্রকে আইনের আওতায় আনতে মাঠে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট।

সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের ৩ জুন ধানমন্ডি এলাকা থেকে পুরস্কার ঘোষিত সন্ত্রাসী আরমানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। বর্তমানে সে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে রয়েছে। সেখান থেকেই নাড়ছেন কলকাঠি। আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস কারাবন্দি আছেন। তার বিরুদ্ধে ৬টি হত্যাসহ ১০টি মামলা বিচারাধীন। আরেক সন্ত্রাসী টিটনকে ২০০৪ সালে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট বাবর এলাহী হত্যা মামলায় আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয় তাকে। ২০০৪ সালের ২৬ জুন আশুলিয়ায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান মারা যান। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে হাতিরঝিল এলাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার পর পালাতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন।

শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর জীবিত না মৃত এখনো খোলাসা হয়নি। আরেক সন্ত্রাসী জব্বার মুন্না ভারতে পালিয়ে আছেন। কামরুল হাসান হান্নান জার্মানি ও মানিক ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থান করছেন। মোল্লা মাসুদ কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিনে মুক্ত হয়ে কলকাতায়ই আছেন। আরেক সন্ত্রাসী আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। আগা শামীম আছেন কানাডায়। কামাল পাশাকে তার বাবা মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে কৌশলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার পর তিনি কারাগারে আছেন। সুব্রত বাইন কয়েক মাস আগে ভারতের একটি কারাগার থেকে বের হয়ে মালয়েশিয়ায় আছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য এসেছে।

২০১২ সালে সরকারের তালিকাভুক্ত আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাস কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গোপনে দেশত্যাগ করেন। তেজগাঁও থানায় করা একটি মামলায় আদালত থেকে জামিনের পর কাশিমপুর কারাগার-২ থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পরপরই দেশত্যাগ করেন বিকাশ। তার ভাই প্রকাশও শীর্ষ সন্ত্রাসী। দুই ভাই এখন জার্মানি আছেন। ২০০৪ সালে ফ্রিডম রাসুকে ধানমণ্ডি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনিও এখন কারাগারে আছেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, অপরাধজগতের নতুন মেরুকরণের ধারাবাহিকতায় নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে আছে মালয়েশিয়ায় পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহীম, দুবাইয়ে পলাতক রবিন ও ভারতে পলাতক শাহাদাত হোসেন। অপরাধজগতের দখল ধরে রাখতে তাদের নতুন সহযোগীরা এখন অতিমাত্রায় সক্রিয়। ইব্রাহীম ও শাহাদাতকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মিরপুর এলাকার অপরাধ সাম্রাজ্য দখলে নিতে মরিয়া কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাসের সহযোগীরা। আবার একসময় শাহাদাতের হয়ে যারা কাজ করত সম্প্রতি তাদের কেউ কেউ নিজস্ব অস্ত্রধারী গ্রুপ গড়ে তুলেছে। ঢাকার অপরাধজগতে একসময় ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীর ইসলাম জয় কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন ব্যাংককে।

সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন। রাজধানীর মিরপুর, শেওড়াপাড়া, পল্লবী ও কাফরুলসহ আশপাশ এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের সহযোগীরা তৎপর। একসময় মিরপুর এলাকার অপরাধ-সাম্রাজ্যের পুরোটাই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এখন তাকে ছাপিয়ে গেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহীম। ঘুরে-ফিরে মালয়েশিয়া ও ব্যাংককে থাকেন তিনি। বিদেশে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছেন মিরপুর এলাকার অপরাধজগতের বড় অংশ।

পুলিশ সূত্র জানায়, সরকারের পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপনে আছে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) দুই সদস্যকে হত্যার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপনে রয়েছে। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে থাকলেও তার ইশারাতেই দেশে দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণেই আছে।

জানা যায়, মতিঝিল, কমলাপুর, পল্টন ও শাহজাহানপুর ও আশপাশের বিশাল এলাকার আধিপত্য দীর্ঘদিন যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার হাতে থাকলেও ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে তিনি জেলে যাওয়ার পর নিহত টিপুর হাতে চলে যায়। বিদেশে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান তাকে ‘গাইড’ করছিলেন। ফলে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও টেন্ডারবাণিজ্যসহ সব ধরনের আধিপত্য সহজেই তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে এসব অপরাধের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থের বড় অংশই জিসানের হাতে চলে যাওয়ায় টিপু নতুন ‘আশ্রয়’ খুঁজছিলেন। যা টের পেয়ে জিসান তার অন্য সহযোগীদের দিয়ে টিপুকে খুনের পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। বর্তমানে খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়াও কারাগারে থাকলেও তার সহযোগীরা এলাকায় সক্রিয়। কারাগার তেকে মোবাইলে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর নিকট ফোনে চাঁদাবাজি করার অভিযোগও রয়েছে।

সূত্র মতে, টিপু মার্ডারকে হাইলাইটস করেই এবার চাঁদাবাজির নতুন মিশন শুরু করেছে এ সকল সন্ত্রাসীরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, বরাবরি আমরা এ সকল সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করি। কেউ যদি এ বিষয়ে হয়রানীর শিকার হন তারা অভিযোগ করলে আমরা পদক্ষেপ গ্রহন করবো। এছাড়াও বিভিন্ন সময় এ সকল সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির ঘটনায় আমরা অনেককেই গ্রেফতার করেছি।
তিনি বলেন, কারা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে কোন যোগ সাজোশ থাকলে থাকলে সেটাও নজরদারীর মধ্যে আনা হবে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পলাতক কিংবা কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করে অনেক অপকর্মকারীদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এ ব্যাপারে কোনো ভুক্তভোগী কারাবন্দিদের স্বজনদের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।