২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ৭:৪০
শিরোনাম:

মার্কিন নাগরিক ফারাইজি হত্যাকাণ্ড : তদন্তে দোষীদের রেহাই দেয়ার অভিযোগ মায়ের

বিশেষ প্রতিনিধি : পুলিশের বাড্ডা জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার (এসি) তয়াছের জাহান ক্ষমতার অপব্যবহার করে মার্কিন নাগরিক হত্যা মামলার চূড়ান্ত অভিযোগ থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক সাফায়েত মাহবুব ফারাইজি হত্যা কা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফারাইজি হত্যা মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছিল।

এদিকে, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যায় অভিযুক্ত পুলিশের এসি তয়াছেরসহ অন্য সব আসামির নাম নেই। তবে ফারাইজির বান্ধবীর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছর পিবিআই ফারাইজি হত্যার এই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে।

এ অবস্থায় বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ফারাইজির মা শামীমুন নাহার লিপি। ছেলেকে হারানোর শোকে নিজের বাড়িতে ভূতুড়ে পরিবেশে একদম একা জীবনযাপন করছেন তিনি। একদিকে ছেলের মৃত্যু শোক, অন্যদিকে ছেলেকে হত্যায় অভিযুক্তদের পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন তিনি। লিপি অভিযোগ করেছেন, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যেন অভিযুক্ত তয়াছের পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে তার সাতখুন মাফ হয়ে যাবে! বিচারের আশা ক্ষীণ হয়ে এসেছে দাবি করে লিপি বলেন, ছেলেকে হত্যার পর থানায় মামলাও করতে পারেননি। এরপর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সহায়তায় আদালতে মামলা করেন তিনি। পরে আদালত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয় পিবিআইকে। কিন্তু সেই তদন্তেও প্রভাব বিস্তার করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে মামলার চূড়ান্ত অভিযোগ থেকে কৌশলে তয়াছের নিজের নাম বাদ দেন।

জানা গেছে, সাফায়েত মাহাবুব ফারাইজি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। তিনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসেন। একদিন তিনি মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বন্ধু সুজানা তাবাসসুম সালাম, মো. আফতাব, মো.শাখাওয়াত ও আসওয়াদসহ কয়েক জনকে। এরপর থেকে মাঝেমাঝে ফারাইজির বাসায় আসতেন সুজানা। পরে ফারাইজির মা লিপি জানতে পারেন যে, সুজানা রাতাদের বাসায় মাদক গ্রহণ করেন এবং ফারাইজিকেও তাতে আসক্ত করার চেষ্টা করেন। বিষয়টি দৃষ্টিকটূ লাগায় সুজানাকে বাসায় আসতে নিষেধ করে দেন লিপি। এর জের ধরে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর সুজানা, আফতাব, শাখাওয়াত ও আসওয়াদ পরস্পর যোগসাজশে ফারাইজির বাসায় এসে তাকে ও তার মাকে গালমন্দ এবং মারধর করেন। তখন লিপি জাতীয় জরুরি সেবায় কল দিলে রামপুরা থানা থেকে পুলিশ এসে বিষয়টি মীমাংসা করে। এরপর ফারাইজি তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

লিপি জানান, ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর তিনি ছেলেকে নিয়ে একটি কাজে গুলশানে যান। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে সুজানা, আফতাব, শাখাওয়াত ও আসওয়াদ অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের আহত করে। এরপর তারা চিকিৎসা নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে গুলশান থানা তা গ্রহণ করেনি। এ ঘটনার দিন আবার হামলাকারীরা লিপির বাড়িতে গিয়ে তাবাসসুমের সঙ্গে ফারাইজির যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখতে বলেন। না হলে ফারাইজি দেশে থাকতে পারবেন না বলেও হুমকি দিয়ে যায়। এরপর ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের অনুষ্ঠান পালন করতে বন্ধু সুজানা তাবাসসুম, আফতাব, শাখাওয়াত ও আসওয়াদের সঙ্গে বের হন। ওই রাতে ফারাইজি আর বাসায় ফেরেনি। পরদিন ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভাটারার একটি বাসা থেকে ফারাইজির লাশ উদ্ধার করা হয়।

এরপর দিনের পর দিন থানায় ঘুরেও ছেলের হত্যার ঘটনায় মামলা করতে পারেননি লিপি। পরে হত্যাকা-ের দেড় মাস পর ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলা করেন তিনি। সেই মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) তয়াছের জাহানসহ আটজনকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন- ভাটারা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান, ফারাইজির বান্ধবী সুজানা তাবাসসুম সালাম, তার সহযোগী আফতাব, শাখাওয়াত, আসওয়াদ, বাড়ির মালিক কামরুল হক ও বাড়ির ব্যবস্থাপক রিপন।

মামলার বাদী শামীমুন নাহার লিপি বলেন, ‘আসামিরা পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যার আলামত নষ্ট করেছে। এমনকি হত্যার ৪৫ দিনেও থানায় মামলা নেয়নি। পরবর্তীতে মার্কিন দূতাবাসের পরামর্শে আমি আদালতে মামলা করি। মামলার প্রধান আসামি সুজানার সঙ্গে বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার তয়াছের জাহান ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) মশিউর বেসামরিক পোশাকে (সাধারণ বেশে) ছিল।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হত্যাকা-ের দিন ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল দিয়ে লিপিকে বলা হয় ফারাইজির মৃতদেহ বাড্ডা থানায় রয়েছে। ছেলের সন্ধানে থানায় গেলে লিপি জানতে পারেন তাকে থানা থেকে কোন ফোন দেওয়া হয়নি। তখন তয়াছের জাহান লিপির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। ওই দিন থানায় প্রায় ১১ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে লিপিকে দিয়ে বিভিন্ন সাদাকাগজে সই করিয়ে নেয় ভাটারা থানা পুলিশ। পরবর্তীতে জানানো হয় ফারাইজির মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রয়েছে।

লিপি বলেন, ‘তয়াছের জাহান আমার ন্তানকে বেওয়ারিশ হিসাবে গুম করতে চেয়েছিল। তাই থানায় যাওয়ার পর তার নির্দেশে পুলিশের অন্যান্য সদস্যরা আমাকে কোন তথ্য দেয়নি। এমনকি আমার সন্তানের মৃত্যুর খবরে আমি থানা কান্না করায় আমার সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে। তার কারণে ওই সময় থানার ওসিও মামলা নিতে পারেননি।’
তিনি আরও বলেন, তয়াছের জাহান বাবু ও এসআই মশিউর আমার যেন মামলা না করি সে জন্য হুমকি দিয়েছে। আমাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। এমনকি সুজানাকে অন্যত্রে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। সবশেষে মামলার তদন্তেও নিজের প্রভাব বিস্তার করেছেন এসি তয়াছের জাহান। প্রভাব খাটিয়ে অভিযোগে উল্লেখিত আসামির তালিকা থেকে সুজানা ছাড়া অন্য সবার নাম বাদ দিয়েছেন তিনি।’

লিপির অভিযোগ, হত্যাকা-ের পর ঘটনাস্থলে গেলে ওই বাসার মালিক এবং বাসার কেয়ারটেকার তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ সময় বাসায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলে তারা খুনের বিষয়টি চেপে যাওয়ার হুমকি দেন। পরদিন ভাটারা থানায় মামলা করতে গেলে সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) তয়াছের জাহান ও উপ-পরিদর্শক মশিউর মামলা না করতে হুমকি দেন। এবং তাকে আমেরিকায় ফিরে যেতে বলেন। এরপর গত বছরের ৯ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর হত্যার বিচার চেয়ে আবেদন করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

তিনি আরও বলেন, মামলার আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফারাইজিকে হত্যা করেছে। পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকা-ের আলামত নষ্ট করার পাশাপাশি তাকে অন্যায় ভাবে নিয়মিত হুমকি প্রদান করে আসছিলেন। নিরুপায় হয়ে আদালতে হাজির হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছিলাম। অথচ সেই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন থেকেও আসামিদের বাদ দিয়েছে তদন্তকারি সংস্থা পিবিআই। আমি ছেলের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী সরোয়ার বলেন, আদালতের পক্ষ থেকে পিবিআইকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পিবিআই তদন্ত শেষে সুজানা তাবাসসুম সালামকে দোষী সাবস্ত করে প্রতিবেদন দাখিলকরেছে। আর বাদবাকি অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।