২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বিকাল ৫:২৯
শিরোনাম:

কৃষকের কাছে আগে আমন আবাদে ধন, তারপর নির্বাচন

সুভাষ দাশগুপ্ত : দেশে আমন ধান চাষ পুরাপুরিভাবে শুরু হয়েছে। যদিও আবহাওয়াগত কারণে খুব ধীর গতিতে চলছে চারা রোপণ। এ ধানকাটার সময়(নভেম্বর- ডিসেম্বর) সারা দেশ মেতে উঠবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে। বলা চলে নির্বাচনী তৎপরতা ও আমন ধানেরচাষ একই সময়ে শুরূ হয়েছে এবং শেষ ও হবে প্রায় একই সময়ে। এবার কৃষকের নবান্ন উৎসব এবং ভোট সম্ভবত একই সময়ে হবে(ডিসেম্বর- জানুয়ারী)। এ কারণে আমন মৌসুমে ধান চাষ এবছর বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ, আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হচ্ছে গ্রাম, যার ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষক। এই কৃষক সমাজই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতির পিতার একমাত্রনাহলেও অন্যতম সশস্ত্র শক্তি। আমরা যে বলি, আওয়ামী লীগকে কেউ ভোটে পরাজিত করতে পারেনা, তার এক মাত্র কারণকৃষক সমাজের ভোট। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আজও তা অটুট। এদেশে উন্নত কৃষির স্রষ্টা ছিলেন জাতির পিতা। তাঁর পদাঙ্কঅনুস্মরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ বাংলাদেশের কৃষিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ভোটে আওয়ামী লীগেরপরাজয় একমাত্র তখনই হবে, যখন কৃষকের ভোট আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই, কৃষক যাতে করে ভাল ফসল এবংফসলের ভাল দাম পাই তার প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। কৃষক ভোটের বাক্স নৌকায় ভর্তি করে দেবে, যদি তারা আনন্দেনবান্ন উৎসব উদযাপন করতে পারে।

মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চালের বাজারে অস্হিরতা দেখা দিয়েছে।স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৮/০৯ সালে, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সংকট দেখা দিয়েছিল। তখন ভারত খুব অল্প পরিমাণে নন-বাসমতি চাল (বলা যেতে পারে মোটাচাল) রফতানি করত। সে সময় ফিলিপাইন যখন ১০ লক্ষ টন চাল আমদানির ঘোষণা দেয়, সাথে সাথে ভারত চাল রফতানিনিষিদ্ধ করে। এর ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম এক লাফে ৭০০ ডলার (মার্কিন ডলার) থেকে ১১০০ ডলারে উঠেযায়। হঠাৎ করে ভারতের এমন সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলে, এমন কি জাতিসংঘ থেকেও নিন্দা জানানো হয়েছিল।

সে সময়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্হায় কর্মরত থাকায় এশিয়া-পেসিফিক অন্চলে(যার অন্তর্ভুক্ত ৪৮ টি দেশ- এফএও) চালের উৎপাদন, প্রাপ্যতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কারিগরি সহায়তা প্রদানের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। এই সুবাদে, আমার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল তৎকালীন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত প্রনব মূখার্জীর সাথে।তাঁর থেকে যখন জানতেচাইলাম, ভারতে যেখানে পর্যাপ্ত চাল মজুদ আছে, তখন হঠাৎ করে কেন আপনারা চাল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকরলেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষকে মাথায় রেখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্হার নীতি প্রনয়ণ ওপরিবর্তন করা হয়, বর্তমান অথবা অদূর ভবিষ্যতের ওপর ভিত্তি করে নয়। তিনি বলেছিলেন- আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরতে নুন্যতম ঝুঁকি নিতে চাই না, তাই এ ব্যাবস্থা।

বর্তমানে ভারত বিশ্বে এক নম্বর চাল রফতানিকারক দেশ। বিশ্বে ৩৭ থেকে ৪০ মিলিয়ন টন চালের রফতানি বাজারে ১৫ থেকে১৮ মিলিয়ন টনের যোগান দেয় ভারত। প্রায় দেড় যুগ পর ভারত আবারও চাল রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।

সম্ভাব্য কারণগুলির অন্যতম হলো গতবছরের থেকে এ বছর বিশ্বব্যাপী চাল উৎপাদন ১০ শতাংশ কমতে পারে, বিশ্ববাজারে এবংভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারে চালের খুচরা মুল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও বিপদজ্জনক হল ভারতে কৃষিতে মোট জমিরপরিমাণ কমছে।অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সরকারী ভাষ্যমতে ভারতে, ২০২২ সালে এ সময়ে খরিফ মৌসুমে আমন ধান চাষেরএলাকা ছিল ১৩.১ মিলিয়ন হেক্টর। এবার তা ১২.১ মিলিয়ন হেক্টর। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এবার ভারতে সময়মত বর্ষা নাআসাতে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার ফলে আমন ধান চাষে সমস্যা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চাল উৎপাদন ও বাণিজ্য পরিস্হিতি এবং পাশের দেশ ভারতে খরিফ মৌসুমে ধান চাষের বাস্তবতাবিবেচনায় রেখে আমাদের এগোতে হবে। আগেই বলেছি এ বছর আমন ধান চাষের গুরুত্ব পূর্ববতী বছর গুলির চেয়ে অনেকঅনেক বেশী।

এ প্রসন্গে বলা প্রয়োজন যে -১৯৯৫ সাল, বিএনপি সরকারের ক্ষমতার শেষ বছর। দেশে চালের মজুদ সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলেআসে। সরকারের গুদামে খাদ্য মজুদ তলানিতে এসে যায়। এই তথ্য সরকার জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে, নির্বাচনআসন্ন। তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ভারত থেকে অবৈধ উপায়ে চাল এনে, দেশের খাদ্য মজুত বৃদ্ধি করা, যাতে করেনির্বাচনকালীন সময়ে চালের দাম বৃদ্ধি না পাই। এই অবৈধ পথ অবলম্বন করেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি।

আমাদের দেশে, আমন মৌসুমে ধানের চাষ শুরূ হয়েছে। নভেম্বর মাসের শেষে এবং কিছু এলাকায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেরমধ্যেই কৃষকের ধান কাটা শেষ হবে এবং শুরু হবে তাদের নবান্ন উৎসব। এর সাথে যোগ হবে জাতীয় নির্বাচন।

এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হচেছ ঘাটে এসে যেন নৌকা ডুবে না যায়। এর মানে হচ্ছে কৃষকের এর জন্য এতকিছু করার পরও যেনওরা কিছুতেই ভোট বিমুখ না হয়। তাই মনে রাখতে হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটের আগে বাংলার কৃষক যেন ভাল ফসলতাদের ঘরে তুলতে পারে। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব দেখা দিবেই, এই চিন্তা মাথায় রেখেই সমস্ত আমন মৌসুমের (জুলাই- ডিসেম্বর) জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে কৃষক পর্যায় পর্যন্ত শক্তিশালী ও সার্বক্ষনিক মনিটরিং ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং খেয়াল রাখতেহবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সার্বক্ষনিক কর্মকান্ড যেন নির্বাচনী কর্মকান্ডের জন্য কিছুতেই বাধাপ্রাপ্ত না হয়।

এই মৌসুমের ধান উৎপাদন মুলত প্রকৃতি নির্ভর। জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অন্য দুই মৌসুমের (আউস ওবোরো) চেয়ে অনেক বেশী। তবে, এবারে কৃষকের সম্ভাব্য বিপদের ভান্ডারে আরও একটি বিপদ যোগ হতে পারে তাহলো- তীব্রদাবদাহ। দাবদাহের কারণে ক্ষতির পরিমান আগের সব রেকর্ড ছাডিয়ে যেতে পারে। ২০২১-২২ সালে মোট ৫২ লক্ষ ৭২ হাজারহেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছিল এবং জমির পরিমাণ ২০২২-২৩ সালেও একই ছিল। কিন্তু এবছর ( ২০২৩-২৪) প্রথমে রোপা আমন চাষের আওতায় জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৫ লক্ষ হেক্টর। পরে নির্ধারণ করা হয় ৫৬ লক্ষ ৩০হাজার

লেখক: প্রাক্তন সিনিয়র টেকনিকাল অফিসার, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা