২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সন্ধ্যা ৬:৫৩
শিরোনাম:

ফজলে বাদশার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই, এমন প্রচলিত ধারাকে ধারণ করে নেতাকর্মীশূন্য অবস্থায় পড়ে যাওয়া রাজশাহী-২ সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা প্রতিপক্ষের সাথেও বসছেন । তিনি গেল শনিবার রাজশাহীর হোটেল এক্স- এ বৈঠক করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুর সাথে। লক্ষ্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফলাফল নিজের অনুকুলে আনার জন্য শেষ প্রচেষ্টা। এদিকে গেল পনের বছরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রিয়তার অভিযোগ ও নানা দোষে অভিযুক্ত ফজলে হোসেন বাদশা এখন তুমুল বিতর্কের নাম, জাতীয় নির্বাচনে তাঁর পাঁচ হাজার ভোটও নেই—-এমন দাবী রাজশাহীর নগরবাসীর।

রাজশাহী-২ সদর আসনের ভোটারেরা বলছেন, জনসমর্থন না থেকেও বারবার করে সংসদ সদস্য বনে যাচ্ছেন এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ফজলে হোসেন বাদশা। অথচ, তিনি নিজ এলাকার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন নাই। বাদশা বিত্ত বৈভবের মালিক বনে গিয়ে এখন বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে কার্যত ধনী নেতা হয়ে গেছেন। বাম ধারার রাজনীতি করতে যেয়ে তিনি কথা রাখতে পারেন নি। শ্রেণী সংগ্রামের লড়াই নয়, বৈষয়িক জীবনকে সঙ্গী করে তিনি এখন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সমালোচিত নেতাও বটে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের জোটের রাজনীতির সমীকরণে বাদশা পুনরায় রাজশাহী সদর-২ আসনের ১৪ দলিয় জোটের প্রার্থী হয়েছেন। প্রতীক পেয়েছেন নৌকা। যা স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মেনে নিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে ফজলে হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে এককাট্টা রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ। তারা কাঁচি প্রতীক নিয়ে আসন্ন নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশাকে সমর্থন দিচ্ছেন।

ফজলে হোসেন বাদশা, একসময় আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়েই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অভ্যাসে ছিলেন। কিন্তু, তার ব্যক্তি চরিত্রে আমুল পরিবর্তন আসায় ধীরে ধীরে তিনি সরকারপন্থী সকলের কাছে বিতর্কিত হয়ে পড়েন বলে সূত্র দাবী করছে। বাদশা, এতটাই স্বৈরাচারী আদলে উত্তরবঙ্গের ক্ষমতাধর রাজনীতিক হয়ে পড়েছেন, যেখানে তার সহধর্মিণী রাজশাহী বরেন্দ্র কলেজের সহকারী অধ্যাপক তসলিমা খাতুন, প্রায় ১৫ বছর ধরে কলেজে যান না , অথচ কলেজে না গেলেও একজন নারীকে ক্লাস নেয়ার জন্য রেখেছেন তিনি। প্রতি মাসে নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলে ওই নারীকে সামান্য অর্থ ধরিয়ে দেন এমপিপত্নী!
এদিকে সম্পদ অর্জনের নেশায় মাতাল ফজলে হোসেন বাদশার সম্পদ ও আয় বেড়েছে। যা গোপন করেও কাজের কাজ হয়নি। গত তিনবারের চেয়ে এবার আয় ও সম্পদ দুটোই বেড়েছে এই সংসদ সদস্যের। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কমিশন অফিসে দাখিলকৃত হলফনামায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। শেয়ার, সঞ্চয় ও ব্যাংক আমানত আছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার ২৪৫ টাকা আছে বলে ঘোষণা রাখলেও রাজশাহীতে চাউর রয়েছে, তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক।

অন্যদিকে ২০১৪ সাল থেকেই ফজলে বাদশা দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ এনে সে সময় রাজশাহী মহানগরীর কাজলা এলাকার অধিবাসী অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক প্রার্থী মমতাজ সুলতানা ফারুকী রাজশাহী সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ফজলে হোসেন বাদশাসহ কলেজ পরিচালনা ও নিয়োগ কমিটির ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ ছিল, শাহ মখদুম (রহ.) কলেজের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে বাদশা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ছিলেন।

মদ্যপানের প্রয়োজনীয়তা ও ইতিবাচক দিক তুলে ধরে ফজলে হোসেন বাদশা প্রায়শই তোপের মুখে পড়েন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজেও বেসামাল হয়ে বক্তব্য বিবৃতি প্রদান করেন, যা সামাজিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কুশপুতুল দাহ করে শিক্ষার্থীরা। রাবি শিক্ষার্থী শাহরিয়ারের মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অসংলগ্ন বক্তব্য দেন বাদশা।

অপরদিকে ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর জাতীয় একটি পত্রিকায় “এমপি বাদশার টিআর প্রকল্পে বরাদ্দের বড় অংশই লুটপাট” – শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, “রাজশাহীর এমপি ফজলে হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্প বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অস্তিত্বহীন ও ভুঁইফোঁড় বিভিন্ন সংস্থাকে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঘুরেফিরে নামসর্বস্ব একই সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিয়ম ভেঙে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাকর্মীরাও বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছেন। জনকল্যাণ প্রকল্পের বরাদ্দ লুটপাট করা হয়েছে।”

২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত “এমপি হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি বাদশা” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নিজস্ব ভোটব্যাংক রাজশাহী সদর আসনে খুব সামান্য। তার পরও গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সমর্থনে রাজশাহী সদর আসনের এমপি হয়ে আসছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তবে তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক মোটেও ভালো নেই। উল্টো নেতাদের সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।”

রাজশাহীর নগর বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, একটা সময় ফজলে হোসেন বাদশা ছাত্রনেতা হিসাবে জনপ্রিয় ছিলেন। সময়ের ব্যবধানে তিনি লুটেরা শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে গেছেন। শ্রেণি বৈষম্য দূরীকরণে ভুমিকা রেখে তিনি জাতীয় পর্যায়ের নেতাও হতে পারেন নি। বড় পদ বাগিয়ে নিলেও তিনি আঞ্চলিক নেতা রয়ে গেছেন। চুপিসারে অর্থ,বিত্ত, বৈভবের মালিক হয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। ভোটের ময়দানেও তিনি অসহায় তথা একা হয়ে পড়েছেন। যেমন কর্ম তেমন ফল, প্রচলিত প্রবাদের ধারাবাহিকতায় বাদশা এখন অনেক টাকার মালিক। এমন বাস্তবতায় নিজ দলের নীতিকে উপেক্ষা করে সামাজিকভাবে জায়গা হারিয়েছেন তিনি। একজন অসৎ রাজনীতিক হওয়ার সকল শর্ত পূরণ করে বাদশা এখন আর জনমানুষের নেতা নন। ঢাল- তলোয়ারবিহীন ‘বাদশা’ অধ্যায় রাজনীতিতে শেষ হচ্ছে বলেও গুঞ্জন চলছে সর্বত্র।