৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৯:৩০
শিরোনাম:

রাবেয়া খাতুনকে সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং দাফন সম্পন্ন

চ্যানেল আই কার্যালয়ে ৪ জানুয়ারি বিকেল ৩টায় রাবেয়া খাতুনের জানাজা শেষে বাদ আসর বনানী করস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্যরা। চ্যানেল আই-এ অনুষ্ঠিত জানাজাতে অংশ নেন বড় জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু। যিনি টেলিভিশন উপস্থাপক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্র“পের পরিচালক। জানাযা শুরুর আগে পরিবারের পক্ষে তিনি কথা বলেন। তিনি রাবেয়া খাতুনের আত্নার শান্তি কামনায় সকলের দোয়া চান। জানাজায় উপস্থিত রাবেয়া খাতুনের জন্য সকলের কাছে দোয়া চান চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ। জানাযাতে অংশ নেন চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্র“পের আরেক পরিচালক রিয়াজ আহমেদ খানসহ চ্যানেল আই পরিবারের সদস্য ও রাবেয়া খাতুনের শুভাক্সক্ষীরা। ৮ জানুয়ারি বাদ জুমআ
চ্যানেল আই মসজিদে রাবেয়া খাতুনের আত্নার মাগফেরাত কামনায় দেয়া অনুষ্ঠিত হবে।

এর আগে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে মরদেহ রাখা হয় সর্ব সাধারনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দু, শিল্প সাহিত্যি ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। এদিন শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ নজরুল মঞ্চের বেদিতে রাখা হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান, মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী, সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ। এ সময় তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন রাবেয়া খাতুন। অর্ধ শতাধিক উপন্যাস ও চার শতাধিক গল্প লিখেছেন তিনি। এমন একজন লেখিকার চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি। তারচেয়ে বড় কথা, তিনি যেই সময়ে সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন, সেসময়ে নারীদের ক্ষেত্রে সেটা খুব সহজ ছিলো না।

কিন্তু তিনি তার কাজে সফল হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে রাবেয়া খাতুনের মতো খুব বেশি লেখিকা পাওয়া যাবে না, তার প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। প্রার্থনা করছি, তার আত্মা যেন শান্তি পায়। তিনি আরো বলেন, রাবেয়া খাতুন শুধু বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেননি বরং তিনি তার পরিবারকে একটি সংস্কৃতিমনা পরিবার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ফরিদুর রেজা
সাগর তার সন্তান, যিনি চ্যানেল আইয়ের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতিকে দারুণভাবে তুলে ধরছেন। লালন করছেন, ধারণ করছেন এবং ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার পুরো পরিবার সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার সন্তানদের প্রতি সমবেদনা জানাই।’ স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত রাবেয়া খাতুন রবিবার ৩ জানুয়ারি ২০২১ বিকালে বাধ্যর্কজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথাসহ চলচ্চিত্র ও নাট্য জগতেও বিচরণ ছিল রাবেয়া খাতুনের লেখনি। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মেঘের পরে মেঘ’ জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্র। ‘মধুমতি’ এবং ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ও প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে। রাবেয়া খাতুনের স্বামী প্রয়াত এটিএম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রথম পত্রিকা সিনেমার সম্পাদক ও বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ এর পরিচালক। ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই এটিএম ফজলুল হকের সাথে পারিবারিকভাবে রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয়। মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র, দুই পুত্রবধু, দুই কন্যা ও দুই জামাতাসহ অসংখ্য নাতি-নাতনি রেখে
গেছেন।

তার বড় ছেলে ফরিদুর রেজা সাগর বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি., চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ছোট ছেলে ফরহাদুর রেজা প্রবাল এক সময়ের টেলিভিশনের জনপ্রিয় উপস্থাপক ও স্থপতি এবং বর্তমানে অষ্টেলিয়া প্রবাসী। বড় মেয়ে কেকা ফেরদৌসী বিশিষ্ট রন্ধনবীদ। বড় জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু টেলিভিশন উপস্থাপক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্র“পের পরিচালক। ছোট জামাতা জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন বিশিষ্ট শিল্পপতি, চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্র“পের পরিচালক। বড় পুত্রবধু কনা রেজা বিশিষ্ট নারী উদ্যোগক্তা ও পানসুপারীর সত্ত্বাধিকারী। ছোট মেয়ে ফারহানা কাকলী সুগৃহিনী।

কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও রাবেয়া খাতুন এক সময় শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতার সংগেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ইত্তেফাক, সিনেমা পত্রিকা ছাড়াও তাঁর নিজস্ব সম্পাদনায় পঞ্চাশ দশকে বের হতো ‘অঙ্গনা’ নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা। তার প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একশ’রও বেশী। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, গবেষণাধর্মী রচনা, ছোটগল্প, ধর্মীয় কাহিনী, ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। রেডিও, টিভিতে প্রচারিত হয়েছে অসংখ্য নাটক, জীবন্তিকা ও সিরিজ নাটক। তার গল্পে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র। রাবেয়া খাতুন উপন্যাস লিখেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি, এযাবৎ কাল
পর্যন্ত চার খণ্ডে সংকলিত ছোটগল্প সংখ্যায় চারশোরও বেশি। ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসও সংখ্যায় কম নয়। রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যের অন্যতম লেখক। কর্মজীবনে অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। উদ্বুদ্ধ হয়েছেন যাঁদের দ্বারা স্মৃতিমূলক রচনার মধ্য দিয়ে তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিত্বকে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। ছোটগল্প দিয়ে শুরু হলেও লেখকপরিচয়ে প্রথমত তিনি ঔপন্যাসিক।

প্রথম উপন্যাস মধুমতী (১৯৬৩) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসাবে পরিচিতি পান। ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনসংকট ও নাগরিক উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার মধ্যে ব্যক্তিকে আবিস্কার করেছিলেন রাবেয়া খাতুন এই উপন্যাসে। রাবেয়া খাতুন ভ্রমণসাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসাবে বিবেচনা করেছেন বলে তাঁর ভ্রমণসাহিত্যের বইও অনেকগুলো। বেশ কিছু আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। একাত্তরের নয় মাস (১৯৯০) বইয়ে লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরূদ্ধকর দিনগুলোর কথা। সাহিত্যর্চ্চার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭), একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণ পদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণ পদক (১৯৯৬), ঝষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)। ছোট গল্পের জন্য পেয়েছেন নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)। সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পরস্কৃত হয়েছেন শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)। ছোটগল্প ও উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে প্রেসিডেন্ট (১৯৬৬), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্র“বতারা, মধুমতি (২০১০) ইত্যাদি।

টিভি নাটকের জন্য পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টাস এসোসিয়েশন মিলেনিয়াম এ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টাস এ্যাওয়ার্ড (২০০০)সহ তিনি এ যাবত অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।